১৯৬৮ সালের বন্যার পর জলপাইগুড়ি ও আলিপুরদুয়ার জেলার চা শিল্পে এতো বড় ক্ষতি হয়নি। ফোনে ধরেছিলাম ডুয়ার্স ব্রাঞ্চ টি অ্যাসোসিয়েশনের সচিবকে। সকালেই খবর পেয়েছিলাম পাহাড়ের অন্তত দশটি চা বাগান ভূমিধ্বসে বিধ্বস্ত। টেরাই ইন্ডিয়ান প্ল্যান্টারস অ্যাসোসিয়েশনের সদস্য মহেন্দ্র পি. বনশলও জানালেন শুধুমাত্র তরাই অঞ্চলেই ৪৫টি চা-বাগান এই দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত। আর ক্ষতি সবচেয়ে বেশি ডুয়ার্সের চা বলয়ের। কনফেডারেশন অফ ইন্ডিয়ান স্মল টি গ্রোয়ার্স অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট বিজয় গোপাল চক্রবর্তীর কাছ থেকেও জানলাম একই কথা। প্রবল জলের চাপে বাঁধ ভেঙে হু-হু করে জল ঢুকে ভেসে গেছে ক্ষুদ্র চা চাষীদের বিঘার পর বিঘা চা বাগান। প্রচুর ছোট চা বাগানে জমে রয়েছে জল। মাথায় হাত পড়েছে চাষীদের। চা বণিকসভাগুলোর শঙ্কা, যেভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তাতে চা বাগিচায় ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ১০০ কোটি ছাড়িয়ে যেতে পারে।
গভীর রাতে নাগরাকাটা ব্লকের বামনডাঙায় তন্ডু চা বাগানে প্রবল বৃষ্টিতে ডায়না নদীর জল শ্রমিকদের ঘরে ঢুকে পড়ে। দু'শোর বেশি চা শ্রমিকের দুদিনের আবাসস্থল ছিল কারখানা। বামনডাঙা বাগান 'বিচ্ছিন্ন দ্বীপ' হয়ে পড়ার পরে রাস্তাটি পাহাড়ি খাদের আকার নেয়। ২৫ মিটার গভীর খাদ এপার ওপার করতে এনডিআরএফ-এর তরফে দড়ি দিয়ে জিপ লাইনার ব্যবস্থা চালু করা হয়। বাগানটা এখন বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মত হয়ে আছে।
মেটেলির বিশ্বজিতের কাছ থেকে খবর পেলাম মেটেলি ব্লকের সোনগাছি চা বাগানের বর্ষীয়ান ম্যানেজার রাধেশ্যাম খান্ডেলওয়ালের বাগান লাগোয়া নেওড়া মাঝিয়ালী গ্রামে নদীর দিকে মুখ করা বাড়ির দূরত্ব ছিল নেওড়া নদীর সঙ্গে ৩০ মিটার। প্রকৃতির তাণ্ডবের পরে সেই দূরত্ব এসে দাঁড়িয়েছে মাত্র তিন মিটার। গোটা বাড়িটাই নদী–গর্ভে তলিয়ে যাওয়ার উপক্রম। বাড়ির সামনের রাস্তাও যে কোন সময় নদীগর্ভে চলে যাবে।
এখন ছিল অটাম ফ্লাশের সময়। কিন্তু জমা জল চা গাছের শত্রু। ইন্ডিয়ান টি অ্যাসোসিয়েশনের ডুয়ার্স শাখার চেয়ারম্যান রাজকুমার মণ্ডলের সঙ্গে কথা প্রসঙ্গে জানলাম যেসব বাগান সম্পূর্ণভাবে জলের তলায় গেছে, জলের স্তর কমে যাওয়ার পর চা গাছগুলিকে অন্তত এক সপ্তাহ পর্যাপ্ত রোদ পেতে হবে। জল যত বেশি সময় থাকে, তত বেশি সিল্ট জমে মাটির উর্বরতা নষ্ট হয়। ভুটানের নদীর জল মানেই ডলোমাইটে ভরা, যা মাটিকে অনুর্বর করে দেয়। আগের এক বন্যায় কালচিনির মেচপাড়া চা-বাগানের বহু একর জমি ডলোমাইট সিল্টেশনের কারণে চাষের অযোগ্য হয়ে গিয়েছিল।
অভূতপূর্ব সংকট, ভয়াবহ বিপর্যয়, প্রকৃতির রুদ্ররূপ মালিক–শ্রমিক দ্বন্দ্ব ঘুচিয়ে তাদেরকে এক মঞ্চে নিয়ে এসেছে। কিছুদিন আগেও ২০ শতাংশ হারে বোনাসের দাবিতে সোচ্চার ছিল বাগিচা শ্রমিকরা। আর আজ প্রবল বর্ষণে একের পর এক চা বাগানে ঢুকে পড়েছে পাহাড়ি ঝোরার জল। লক্ষ্মীপাড়া, গ্রাসমোর, গাঠিয়া, বেতগুড়ি–সহ বহু চা বাগানে জল জমায় শ্রমিকদের পাশাপাশি মালিকপক্ষও বড় ক্ষতির সম্মুখীন। ব্রিটিশ আমলে তৈরি সাহেবি কেতাদুরস্ত চা বাগানের ম্যানেজারদের বাংলোগুলোতে যেমন জল ঢুকেছে, তেমনি শ্রমিক আবাসনেও। প্রবল বৃষ্টিতে ডুয়ার্স ও তরাই অঞ্চলের বড় ও ছোট প্রায় সব চা-বাগান মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত। জলপাইগুড়ির বানারহাট, নাগরাকাটা, মাল, ময়নাগুড়ি ও সদর ব্লকের অধিকাংশ বাগানই জলের তলায়। শ্রমিকদের বাড়িঘর ভেসে গেছে, চা-বাগানের ‘লাইন’ গুলিতে জল ঢুকে পড়েছে। কোনটা ছেড়ে কোন বাগানের নাম বলব?
প্রবল বর্ষণে ক্ষতি হয়েছে বাগানের রাস্তা, কালভার্ট, শ্রমিকদের আবাসন। কোথাও জলে ডুবেছে বাগান, কোথাও জলের স্রোতে গাছ উপড়ে ভেসে গিয়েছে, চা-বাগানের ভেতরের রাস্তা, ছোট সেতু ও ড্রেনেজ ব্যবস্থা সম্পূর্ণ ভেঙে পড়েছে। বৃষ্টিপাতের কারণে কারখানাগুলিতে বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যাহত হয়েছে, যার ফলে চা পাতা প্রক্রিয়াজাতকরণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বহু বাগানে নদীর বাঁধ ভেঙে গিয়েছে। জলপাইগুড়ির বানারহাটের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হাতিনালার স্রোত চুনাভাটি এস্টেটে চা গাছের জন্মানো মাটি ক্ষয় করে ফেলেছে। তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ না নেওয়া হলে আরও দুটি চা বাগানের কারখানা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
চারপাশ তাকালে শুধুই ধ্বংসলীলা। বিভিন্ন কারখানায় ঢুকে গিয়েছে জল। নষ্ট হয়েছে কয়েক লক্ষ কেজি তৈরি চা পাতা। মাথায় হাত কারখানার মালিকদের। ফোনে ধরলাম নাগরাকাটা পঞ্চায়েত সমিতির সঞ্জয় কুজুরকে। জানলাম আলিপুরদুয়ারের অধিকাংশ বৃহদায়তন চা বাগিচা প্রায় জলমগ্ন। চা বাগানের সাথে সংযোগকারী রাস্তাগুলি আকস্মিক বন্যায় ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত।
চা বিশেষজ্ঞ রাম অবতার শর্মাজী ব্যস্ততার মধ্যেই জানালেন, রাস্তাঘাটের বেহাল অবস্থার কারণে বাগানে কয়লা, ডিজেল এবং খাদ্যশস্য পৌঁছোবার জন্য যানবাহন প্রবেশ করতে পারছে না। বিভিন্ন বাগানে হাজার হাজার কিলো মজুত চা নিলামে পাঠানো যাচ্ছে না। আলিপুরদুয়ারের জেলা শাসকের দপ্তর থেকে অনেক সাধ্যসাধনার পর জানা গেল, নদীর জলস্তর না কমলে খুব বেশি কিছু করা সম্ভব নয়। তবে বিপর্যস্ত এলাকা পরিদর্শনে টিম পাঠানো হয়েছে। ক্ষতির পূর্ণাঙ্গ রিপোর্ট তৈরি হচ্ছে।
ততক্ষণ নিয়তি মেনে নিয়েই প্রকৃতি দেবীর কৃপার অপেক্ষায় থাকবে চায়ের ডুয়ার্স!
Have an account?
Login with your personal info to keep reading premium contents
You don't have an account?
Enter your personal details and start your reading journey with us
Design & Developed by: WikiIND
Maintained by: Ekhon Dooars Team