কিছুদিন আগেই মুক্তিপ্রাপ্ত বাংলা সিনেমা 'চিনি'-তে ব্যবহৃত ‘তোমার চোখের শীতলপাটি’ গানটি খুব জনপ্রিয়তা পেয়েছে। এই গানের সূত্রেই হোক বা ব্যবহারের অভিজ্ঞতায় শীতলপাটির সঙ্গে অনেক বাঙালিরই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ পরিচয় রয়েছে। ‘শীতলপাটি’ নামটি শুনেই বোঝা যায় অসহ্য গরমের হাত থেকে বাঁচানোর জন্য বা শরীরকে প্রাকৃতিক উপায়ে শীতল রাখতে এর মাদুরের জুড়ি নেই। বিশেষ করে যারা ব্যবহার করেন নিয়মিত তারা অবশ্যই জানেন সেকথা।
বর্তমান বিশ্বে করোনাকালে স্বাভাবিক জীবনযাপন বাধাপ্রাপ্ত হয়েছে। অকালে মৃত্যুবরণ করতে বাধ্য হয়েছেন বহুসংখ্যক মানুষ। মানুষের জীবন কাটছে এক আতঙ্কের মধ্যে। তবে মৃত্যুর পরিসংখ্যান দেখে বোঝা যাচ্ছে গ্রামের থেকে শহরের মানুষের করোনাতে মৃত্যু হয়েছে বা হচ্ছে তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা এর প্রধান কারণ হিসেবে দেখেছেন শহরের মানুষের আধুনিক যন্ত্রকেন্দ্রিক জীবনযাপন প্ৰণালীকে। আমরা গরমের মরশুমে অনেকেই এসি চালিয়ে আরামে থাকি। কিন্তু আমরা বুঝতেও পারি না এই ক্ষণিকের আরাম আমাদের জীবনী শক্তিকে কতটা কমিয়ে দিচ্ছে। আর তার প্রমাণ কিন্তু করোনাকালে পাওয়া যাচ্ছে। তবে এর বিকল্প হিসেবে অবশ্যই ব্যবহার হতে পারে সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক উপায়ে তৈরি ‘শীতলপাটি'। যার ব্যবহারে বিন্দুমাত্র পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হওয়ার সম্ভাবনা আছে বলে মনে হয় না। আর এই মহামারির অভিজ্ঞতা থেকে অনেক বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকই আমাদের যতটা পরিমাণে বেশি সম্ভব প্রাকৃতিক জিনিস ব্যবহারের কথা বলেছেন। আর এই শীতলপাটির ব্যবহার বৃদ্ধি পেলে একদিকে যেমন শরীর বাঁচবে, অন্যদিকে এই জীবিকার সঙ্গে যুক্ত হাজার হাজার মানুষের জীবন ও জীবিকার নিরাপত্তা তৈরি হবে।
কিন্তু প্রায় দু-বছর ধরে করোনার করালগ্রাসে পাটিশিল্পীরা বিশাল ক্ষতির মুখে। গত একবছরের বেশি সময় ধরে সম্পূর্ণ বা আংশিক লকডাউনের কারণে এদের জীবন ও জীবিকা কার্যত দিশাহারা। পাটি ব্যবসা মূলত আসাম রাজ্যকেন্দ্রিক। কিন্তু লকডাউনের কারণে সেখানে পাটি নিয়ে যাওয়া বা বিক্রি করা সম্ভব হচ্ছে না। এছাড়া পাটি দিয়ে নানান রকম দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহৃত বিভিন্ন রকম সামগ্রী তৈরি হয়, যেমন ব্যাগ, জুতা, টুপি, মোবাইলের কভার, কলম দানি বা ফুলদানির কভার। সেই ব্যবসারও ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। যার সরাসরি প্রভাব পড়েছে পাটি শিল্পীদের স্বাভাবিক জীবনে।
কিন্তু অনেকেরই অজানা যে বিষয়টি তা হল—কোথায়, কীভাবে তৈরি হয় শীতলপাটি? তৈরি করেন কারা? কোথায় তাদের বাস? পাটি হাতে না মেশিনে তৈরি হয়-- এই নিয়েও রয়েছে অনেক কৌতূহল। কোচবিহার-দিনহাটা রোডে তোর্ষা নদীর তীরবর্তী ঘুঘুমারীতে এসে পাকা রাস্তা ধরে চলতে চলতে রাস্তার দুপাশে চা বাগানের মত দেখতে তন্তু জাতীয় গাছগুলি দেখে আপনার চোখ অল্প সময়ের জন্য থেমে যেতেই পারে। এই যে রাস্তার পাশে তন্তুজাতীয় ঝোঁপের মত দেখতে গাছগুলোই হল শীতলপাটি তৈরির কাঁচামাল। যেগুলিকে পাটিশিল্পীরা বেত গাছ বা শুধু বেত বলে থাকেন। তবে শুধু ঘুঘুমারীতে নয়, কোচবিহার জেলার বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে পাটিশিল্পীদের বাস। ফলে জেলার বিভিন্ন জায়গায় এই বেত গাছ দেখা যায়। কোচবিহার জেলার সদর মহকুমার অন্তর্গত ঘুঘুমারী, দেওয়ানহাট, পুষনাডাঙ্গা, সাহেবেরহাট, বাইশগুড়ি, পেস্টার ঝাড় এবং তুফানগঞ্জ মহকুমার অন্তর্গত তুফানগঞ্জ, দেওচড়াই, বারোকোদালী ও ধনমতীয়া প্রভৃতি জায়গায় এই পাটিশিল্পীদের বাস রয়েছে।
তবে সমস্ত পাটিশিল্পীর জীবন ও জীবিকা ঘুঘুমারীকে কেন্দ্র করেই। জেলায় একমাত্র ঘুঘুমারীতেই সপ্তাহে দুদিন সোমবার ও বৃহস্পতিবার হাট বসে। জেলার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে শিল্পীরা তাদের তৈরি পাটি নিয়ে হাটে আসেন বিক্রির উদ্দেশ্যে। জেলার বিভিন্ন প্রান্তে কয়েক হাজার শিল্পীর বাস থাকলেও অধিক সংখ্যকের বাস ঘুঘুমারী ও সংলগ্ন অঞ্চলে। আমাদের পার্শ্ববর্তী রাজ্য আসামেও পাটি শিল্পীদের বাস রয়েছে। তবে ভারতবর্ষের মধ্যে সবচেয়ে বেশি পাটি তৈরি হয় ঘুঘুমারীতেই যা সারা দেশের চাহিদা পূরণ করে থাকে। গুণ বা মানের দিক থেকেও এখানকার পাটি বিখ্যাত। শুনলে অবাক হতে হয়, এখানে তৈরি পাটির ৮০-৯০ শতাংশই আসামের বাজারে চলে যায়। মহাজনরা শিল্পীদের কাছ থেকে সরাসরি পাটি কিনে বাইরে রপ্তানী করে থাকেন। মোট কথা পাটিশিল্পীদের ব্যবসা বা জীবন আসাম রাজ্যের চাহিদার উপর অনেকটাই নির্ভর।
জনপ্রিয়তার দিক থেকে শীতলপাটি বিখ্যাত হলেও ছোটো-বড়ো আরো বিভিন্ন রকম পাটি তৈরি হয়ে থাকে। যেমন আট গন্ডা, দু পনি, তিন পনি ইত্যাদি। তবে সব পাটির থেকে শীতলপাটি তৈরি যথেষ্ট পরিশ্রমসাধ্য ও ব্যয়বহুল। সাধারণ ভাবে তৈরি পাটির চাহিদা থাকলেও বর্তমানে বৈচিত্র্য আনার জন্য শিল্পীরা পাটির উপরে নানান কারুকার্য ও নকশা করে থাকেন।
সমস্ত রকম প্রাকৃতিক উপায়ে চাষ করা হয় বেত গাছ। একবার বেত গাছের চাষ করলে দেড় থেকে দুবছর অন্তর পাটি তৈরির উপযুক্ত বেত তৈরি হয়। আর দ্বিতীয়বার চাষের প্রয়োজন হয় না। বছরের পর বছর সেই জমি থেকেই বেতের জন্ম হয়ে থাকে, অনেকটা বাঁশের মত। তবে পাটি তৈরির কাজে পরিবারের পুরুষ ও নারী উভয়েরই ভূমিকা থাকলেও তাদের কাজের ধরন আলাদা। সাধারণত জমি থেকে বেত কেটে আনা এবং সেই বেতকে পাটি তৈরির উপযুক্ত করে তোলার এই পরিশ্রমসাধ্য কাজটি করে থাকেন পরিবারের পুরুষেরা। আর পরবর্তীকালে সেই বেতের থেকে পাটি তৈরির কাজটি, যা তুলনামূলক আয়াসসাধ্য—সম্পন্ন করেন বাড়ির মহিলারা। পাটিশিল্পীদের জীবন যেহেতু এই কাজের উপরেই নির্ভরশীল, আর এটি একটি হস্তশিল্প; তাই জীবন ও জীবিকার কারণে পরিবারের আট থেকে আশি সব সদস্যই কাজের ধরন অনুযায়ী সাহায্য করে থাকে।
খুব স্বচ্ছলভাবে না হলেও সব কিছুই চলছিল একরকম। জমি থেকে বেত নিয়ে আসা, বেত থেকে বিশেষ উপায়ে পাটি তৈরি করা। সেই পাটি নিয়ে হাটে বিক্রি করে সেই টাকায় স্ত্রী-সন্তানসহ স্বাভাবিক জীবনযাপন। সবই চলছিল অভ্যস্ত ছন্দে। কিন্তু তাদের ছন্দপতন ঘটল করোনাকালে। কুড়ি সালের প্রথম থেকেই করোনার আতঙ্ক ও ভয়াল রূপের ব্যাপক প্রভাব পড়েছে পাটিশিল্পীদের জীবন ও জীবিকায়। পাটি তৈরির কাজ সারা বছর সব মরশুমে সমান ভাবে চললেও গ্রীষ্মকালে পাটির চাহিদা থাকে তুঙ্গে। স্বাভাবিকভাবেই এই সময়ে দামও বৃদ্ধি পায়। শিল্পীরা সারা বছর ধরে এই সময়ের অপেক্ষা করতে থাকেন। অনেকে বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি সংস্থা থেকে ঋণ নিয়ে পাটির ব্যবসা করেন বা গ্রীষ্মের মরশুমে বিক্রির জন্য পাটি মজুত করে রাখেন ভালো দামের আশায়।
করোনা পরিস্থিতির আগে একটি ৫ বাই ৭ ফুট মাপের শীতলপাটি পাইকারি বাজার মূল্য ছিল প্রায় ৭০০-৭৫০ টাকা। এই মাপের একটি শীতলপাটি তৈরিতে যে কাঁচামাল মানে বেতের ব্যবহার হয় তার মূল্য ১২০-১৫০ টাকা। আবার একটি ৬ বাই ৭ ফুট মাপের শীতলপাটির পাইকারি বাজার মূল্য ছিল ৯০০-১০০০ টাকা, কাঁচামাল লাগে প্রায় ২০০-২৫০ টাকার। আর এমন একটি পাটি তৈরিতে একজন পুরুষ ও একজন মহিলার প্রায় দুদিন সময় লাগে। যেহেতু সবার কাজের দক্ষতা সমান নয়। ফলে পাটি তৈরির ক্ষেত্রে অনেকেরই আরও বেশি সময় লাগে। সেই দিক থেকে দেখতে গেলে শিল্পীদের প্রাপ্য শুধু নিজের পারিশ্রমিকটুকু কিন্তু সেটুকুর জন্যেও সকাল থেকে রাত্রি হাড়ভাঙা পরিশ্রম করতে হয়। পরিশ্রমের তুলনায় অর্থের পরিমাণ অনেক কম হওয়ায় অনেকেই বর্তমানে এই পেশা ছেড়ে অন্য পেশায় যুক্ত হচ্ছেন। কেউ বা জীবন ও জীবিকার তাগিদে পাড়ি দিচ্ছেন ভিন রাজ্যে। সরকারিভাবে শিল্পীদের সাহায্য করতে কিছু উদ্যোগ নেওয়া হলেও প্রয়োজনের তুলনায় তা খুবই নগণ্য।
এমন দুরবস্থার মধ্যে মড়ার উপরে খাড়ার ঘায়ের মত এসে উপস্থিত হয়েছে করোনা। গরমের মরশুমে যে শীতলপাটির পাইকারী বাজার মূল্য থাকে ৭০০-৭৫০ টাকা, সেই পাটি এখন বিক্রি হচ্ছে ৪০০-৪৫০ টাকায়। গত প্রায় দু-বছর থেকে সবচেয়ে বড়ো সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন পাটি শিল্পীরা এই কারণে যে, বছরের যে সময়ে পাটির দাম একটু বৃদ্ধি পায় ঠিক সেই সময়েই করোনার দাপটে লকডাউন চলছে। ফলে পাটিশিল্পীদের জীবনে নেমে এসেছে চরম দুর্দশা। এর থেকে মুক্তি ঘটবে কবে? কেউ জানে না। বেশিরভাগ পাটিশিল্পীদের চোখে মুখে একটা হতাশা ও আতঙ্কের ছাপ।
বিভিন্ন সংস্থা থেকে ঋণ নিয়ে এখন তাদের নাভিশ্বাস অবস্থা। ঋণের কিস্তির থেকে অব্যাহতি নেই অন্যদিকে পাটির দাম এতটাই কমে গেছে যে, সেই দামে বিক্রি করে অনেকের তিনবেলা খাবার জোটানোই কষ্টসাধ্য হয়ে পড়েছে। এর পরে আবার রয়েছে কাঁচামাল বা বেত কেনা। যারা নিজের জমিতে চাষ করে তাদের বেত কিনতে হয় না। কিন্তু যাদের নিজের জমি নেই তাদের বেত কিনতে হয় অন্যের জমি থেকে। ফলে বর্তমানে যে দামে পাটি বিক্রি হচ্ছে তাতে ঋণ তো শোধ হচ্ছেই না বরং সংসার চালাতে অনেকেই মহাজনের কাছ থেকে ঋণ নিতে বাধ্য হচ্ছে।
শিল্পীদের কথায় আরো একটি বড়ো সমস্যা হল শীতলপাটি তেমন কোন নিত্যপ্রয়োজনীয় আবশ্যিক জিনিস নয়, এটি মানুষ সাধারণত শখের বা আরামের জন্য ব্যবহার করে থাকে। করোনার কারণে যখন মানুষের দৈনন্দিন জীবন চালাতেই নাভিশ্বাস অবস্থা তখন এমন শখের জিনিস ক্রয় করাকে মানুষ বিলাসিতা ভাবছে। আর স্বাভাবিকভাবেই এর প্রভাব পড়েছে তথাকথিত শখের জিনিস প্রস্তুতকারী শীতলপাটি শিল্পীদের জীবনে।
কোচবিহার জেলার দক্ষিণ বিধানসভা কেন্দ্র ও নাটাবাড়ি বিধানসভা কেন্দ্র এই দুই বিধানসভার প্রার্থীর হারা-জেতা অনেকটাই নিয়ন্ত্রিত হয় এই পাটিশিল্পীদের ভোটের উপরে। কিন্তু শিল্পীদের অভিযোগ যে বা যারাই জিতুক না কেন তাদের জীবনের কোনও পরিবর্তন হয় নি। তারা যে তিমিরে, সেই তিমিরেই আছে।
অন্যান্যবারের ব্যস্ত শীতল পাটির বাজার এবার শূন্য।
Have an account?
Login with your personal info to keep reading premium contents
You don't have an account?
Enter your personal details and start your reading journey with us
Design & Developed by: WikiIND
Maintained by: Ekhon Dooars Team