× home হোম archive আগের ওয়েব সংখ্যা panorama ডুয়ার্স সম্পর্কে play_circle_filled ভিডিও file_download মুদ্রিত সংখ্যার পিডিএফ library_books আমাদের বইপত্র
people এখন ডুয়ার্স সম্পর্কে article শর্তাবলী security গোপনীয়তা নীতি local_shipping কুরিয়ার পদ্ধতি keyboard_return বাতিল/ফেরত পদ্ধতি dialpad যোগাযোগ
login লগইন
menu
ad01112021105753.jpg
×
সংখ্যা: ফেব্রুয়ারি, ২০২২
সম্পাদকের কলম
বসন্ত এসে গেছে!
প্রদোষ রঞ্জন সাহা
পর্যটনের ডুয়ার্স
সামসিং ফাঁড়ির মেজর হোম স্টে
শ্বেতা সরখেল
ধারাবাহিক প্রতিবেদন
গ্রামীণ ব্যাংক কর্মীদের বেতন-পেনশন-সুবিধা আদায় হয়েছে প্রবল আন্দোলন করেই। পর্ব-৮
প্রশান্ত নাথ চৌধুরী
ধারাবাহিক প্রতিবেদন
উত্তরবঙ্গের লোকসংস্কৃতি ও সংস্কৃতির লোকজন। কোচবিহার। পর্ব - ৪
সব্যসাচী দত্ত
ধারাবাহিক উপন্যাস
ডাউন হলদিবাড়ি সুপারফাস্ট। পর্ব - ১৬
সুজিত দাস
নিয়মিত কলম
কোচবিহার কড়চা। ঘোষিত ‘হেরিটেজ শহর’এর হাল কি এতটুকু বদলেছে?
অরবিন্দ ভট্টাচার্য
নিয়মিত কলম
ল্যাব ডিটেকটিভ। পর্ব - ৫। দশ বছর বাদে মাটির নীচ থেকে বের হওয়া কংকাল থেকে সনাক্ত হল কিশোরী ও তার খুনীরা
নিখিলেশ রায়চৌধুরী
নিয়মিত কলম
আমচরিত কথা। পর্ব – ১২। জীবন নামক যাত্রাপালা
তনুশ্রী পাল
নিয়মিত কলম
এই ডুয়ার্স কি তোমার চেনা? ডুয়ার্স রানি লেপচা খা
শৌভিক রায়
পুরানের নারী
নারদ পত্নী সুকুমারী
শাঁওলি দে

উত্তরবঙ্গের লোকসংস্কৃতি ও সংস্কৃতির লোকজন। কোচবিহার। পর্ব - ৪

সব্যসাচী দত্ত
Loksongskriti_4

পশ্চিমবঙ্গের উত্তর-পূর্ব প্রান্তের জেলা কোচবিহার। গঙ্গার উত্তরদিকের জনপদের মধ্যে এই জেলার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও মানুষের জীবনচর্যার নিজস্ব পরিচিতি আছে। তা অন্যান্যদের থেকে স্বতন্ত্র। কারণ কোচবিহারে বিভিন্ন জনজাতি প্রবেশ করেছে। বসবাস করেছে। নিজস্ব সাংস্কৃতিক প্রভাব ফেলেছে। পাশাপাশি ভারতের বাকি অংশ থেকে কোচবিহার নিজেকে অনেকটা সময় পৃথক রাখতে পেরেছে। দীর্ঘসময় একটি শক্তিশালী রাজতন্ত্র এখানে শাসন করেছে। ফলে এই জনপদের স্বাধীন ও প্রাচীন দীর্ঘ একটি ইতিহাস রয়েছে। শিল্প ও সংস্কৃতিরও ঐতিহ্যবাহী ধারা অতীত থেকেই বহমান। তোর্সা নদীর পারে গড়ে ওঠা এই জেলার পূর্বদিকে অসম ও বাংলাদেশ। দক্ষিণে বাংলাদেশ, উত্তরে জলপাইগুড়ি পশ্চিমে বাংলাদেশ ও জলপাইগুড়ি। ‘কোচবিহার’ শব্দটির ভাবগত অর্থ ‘কোচ জাতির বাসভূমি’। বৃটিশ শাসনের অবসানে ভারত স্বাধীন হয় ১৯৪৭ খ্রীষ্টাব্দে। কিন্তু ১৯৪৯ সাল পর্যন্ত সামন্ত্রতান্ত্রিক রাজার দ্বারা শাসিত স্বতন্ত্র ভারতীয় রাজ্য কোচবিহার। ১৯৪৯ সালের ১২ সেপ্টেম্বর মহারাজা জগদীপেন্দ্রনারায়ণ ভারতের রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের কারণে ভারত সরকারকে এই প্রশাসন হস্তান্তর করেন। ৩০ জানুয়ারি ১৯৫০ সালে একটি জেলা রূপে কোচবিহার পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে যুক্ত হয়।

কোচ রাজতন্ত্রের উদ্ভব হয়েছিল লোকায়ত ভূ-স্বামী থেকে। প্রজ্ঞা ও সময়োপযোগী ক্ষমতায় এই রাজতন্ত্র উত্তরবঙ্গের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তুলতে পেরেছে। একারণেই বিভিন্ন সময়ে প্রতিকূল অবস্থা থাকা সত্ত্বেও কোচ রাজতন্ত্র বিপন্ন হয়েছে কিন্তু ধ্বংস হয়ে যায়নি। নিজেদের শক্তিতেই অনেক বড় শাসন অঞ্চল গড়ে তুলতে পেরেছে ও তাকে বজায় রাখতে পেরেছে। কোচবিহার স্বতন্ত্র রাজতন্ত্র রূপে গড়ে ওঠার পূর্বে এই অঞ্চল বর্তমান অসমের কামরূপ রাজ্যের অন্তর্গত ছিল। ভারতের উত্তর-পূর্বের এই অঞ্চল একসময় ‘প্রাগজ্যোতিষপুর’ নামে পরিচিত ছিল। আর তা ছিল অত্যন্ত সমৃদ্ধ একটি অঞ্চল। মহাভারত, হরিবংশ, শ্রীমদ্‌ভাগবৎ, রঘুবংশম, মৎস পুরাণ প্রভৃতি গ্রন্থে ‘প্রাগজ্যোতিষপুর’এর উল্লেখ পাওয়া যায়। পরবর্তীকালে এই অঞ্চল কামরূপ নামে পরিচিতি লাভ করে। কামরূপ চারটি পীঠে বিভক্ত ছিল। শাসন কার্যের সুবিধার জন্যই এই চারটি ভাগ করা হয়েছিল বলে অনুমান। এই চারটি পীঠ হ’ল কামপীঠ, রত্নপীঠ, সুবর্ণপীঠ ও সৌমারপীঠ। বর্তমান কোচবিহার রত্নপীঠের অন্তর্গত ছিল।

কোচ জনজাতি মঙ্গোলীয় আদিবাসী গোষ্ঠী। এই গোষ্ঠী আর্যদের প্রবেশের পূর্বেই এই অঞ্চলে বসতি স্থাপন করেছিল। উৎসগত দিক দিয়ে কোচ জনজাতি বৃহৎ ‘বরো’ জনগোষ্ঠী পরিবারভুক্ত। বরোরা খ্রিষ্টপূর্ব দশম শতকে ব্রক্ষ্মপুত্র নদের পাড়ে বসতি স্থাপন করে। ধীরে ধীরে অসম সহ উত্তর-পূর্ব বঙ্গে ছড়িয়ে পড়ে। বরো শব্দের অর্থ ‘জ্ঞান’ বা ‘হুঁশ’। আর একটি অর্থ ‘মানুষ’। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করা যায় ‘মেচ’ পূর্বে ‘মিচ’ নামে পরিচিত ছিল। মিচ নামের সঙ্গে মেচি নদীর একটি সম্পর্ক রয়েছে। মিচ শব্দের একটি অর্থ ‘মানুষ’ও বটে। যেমন ‘মিজো’ (মি—মানুষ, জো—উঁচুস্থান) অর্থাৎ উঁচুস্থানের মানুষ বা পর্বতের মানুষ। তেমনই ‘হাজো’ (হা—মাটি, জো—উঁচুস্থান) অর্থাৎ মাটির উঁচু ঢিবির ওপর বসবাসকারী মানুষ। আবার ‘মিচা’ (মি—মানুষ, চা—সন্তান)। বরোকিচা মানে বরোদের সন্তান।

ঐতিহাসিক মতানুযায়ী হরিদাস মন্ডল (অনেকে বলেন হারিয়া মন্ডল)-কে আমরা কোচ রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা রূপে গণ্য করতে পারি। তিনি ছিলেন কোচ জনগোষ্ঠীর একজন গোষ্ঠীপ্রধান, চিকনা পর্বতের ছোট এক ভূ-খন্ডের মালিক। হরিদাস মন্ডলের পূর্ব পরিচয় পাওয়া যায় ‘দরঙ্গবংশাবলী’, খড়গ নারায়ণ বংশাবলী, গন্ধর্ব নারায়ণ বংশাবলী, হরকান্ত বড়ুয়ার লেখা অসম-বুরুঞ্জী থেকে।

এখনকার জলপাইগুড়ি জেলা শহরের অদুরেই অবস্থিত প্রখ্যাত শিবস্থান ‘জল্পেশ’। অত্যন্ত প্রাচীন শিবের স্থান এটি। অতীতের প্রায় জঙ্গলাকীর্ণ এই অঞ্চলে কোচ গোষ্ঠীপতি হরিদাস মন্ডল থেকেছেন। যদিও তাঁর আদিনিবাস ছিল রত্নপীঠের অন্তর্গত বিস্তির্ণ অঞ্চলের একটি অংশ পূর্বল্লেখিত ‘চিকনা’য়। হরিদাস মন্ডলের বিবাহ হয়েছিল আর এক কোচ সর্দার ‘হাজো’-র দুই কন্যা ‘হিরা’ ও ‘জিরা’-র সঙ্গে। বর্তমান গৌহাটি শহরের উত্তর-পশ্চিমে যাঁদের বসবাস ছিল।

জিরার গর্ভে ‘চন্দন’, হিরার সন্তান ‘বিশ্বসিংহ’ ও ‘শিশ্বসিংহ’ জন্মগ্রহন করেন। জিরা পরে ‘মদন’ নামে এক পুত্র সন্তানের জন্ম দেন। হরিদাস মন্ডলের এই চার পুত্রের মধ্যে সর্বাপেক্ষা বুদ্ধিমান, বলবান ও সাহসী ছিলেন বিশ্বসিংহ। হরিদাসের গড়ে তোলা বেশ বড় একটি অঞ্চলের শাসন কার্য সম্পাদন করবার সবচেয়ে উপযুক্ত ছিলেন বিশ্বসিংহ। কিন্তু জিরা অনুরোধ করলেন চন্দনকে সিংহাসনে বসাবার জন্যে। হরিদাস স্ত্রীর এই আবদার এড়াতে পারলেন না। কারণ জিরার অন্য সন্তান মদন রাজ্যবিস্তারের যুদ্ধে নিহত হয়েছিলেন। চন্দন বসলেন সিংহাসনে। তাঁর শাসনের মধ্য দিয়েই কোচ রাজতন্ত্রের এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা হ’ল। তাঁর সময় থেকেই এখানকার ‘রাজশক’-এর গণনা শুরু হয়। চন্দন ১৫১০ থেকে ১৫২২ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত রাজত্ব করার পর রোগগ্রস্ত হয়ে পরলোক গমন করেন।

চন্দনের মৃত্যুর পর ১৫২২ খ্রিষ্টাব্দে কোচ সিংহাসনে বসলেন বিশ্বসিংহ। তিনি রাজ্যকে বহুদূর বিস্তার করেন। তিনিই কোচজাতিকে ক’রে তোলেন অপরাজেয় শক্তিশালী। পশ্চিমে করতোয়া নদী থেকে পূর্বে বরো নদী পর্যন্ত তাঁর অধিকার বিস্তৃত করেছিলেন। তিনি চিকনা পর্বত থেকে রাজধানী নিয়ে আসেন আলিপুরদুয়ারের মহাকালগুড়ির কাছে হিঙ্গুলাবাসে। তিনি ‘আমতেশ্বর’ উপাধি গ্রহণ করেন। অন্য ভাই শিশ্বসিংহ ‘বৈকুন্ঠপুর’এর দায়িত্ব পেলেন। তাঁর উপাধি হ’ল রায়কৎ। শিশ্বসিংহ রাজার মর্যাদা পেলেন না। তিনি হলেন কোচ রাজবংশের অধীনস্থ বৈকুন্ঠপুর রাজ এস্টেটের দায়িত্বপ্রাপ্ত। নির্দিষ্ট হ’ল যে কোচবিহার রাজার রাজ্যাভিষেকের সময় এই রায়কৎরা তাঁদের ছত্রধর হবেন। তবে শিশ্বসিংহ স্বাধীন ক্ষমতাই ভোগ করতেন। এই বৈকুন্ঠপুর থেকেই পরবর্তীকালে জলপাইগুড়ি জেলার উৎপত্তি।

বিশ্বসিংহই প্রথম রাজবংশী কথাটি গ্রহণ করেন। এ সম্পর্কে ড. হাণ্টার ১৮৭৬ সালের ‘স্ট্যাটিসটিক্যাল অ্যাকাউন্ট অফ বেঙ্গল’-এর দশম খন্ডে উল্লেখ করেন। ‘পঞ্চদশ শতকের শেষে কোচ রাজা হাজো কামরূপ রাজ্য স্থাপন করেন। তাঁর দৌহিত্র বিশ্বসিংহ সহচরবর্গ সহ হিন্দু ধর্ম গ্রহণ করেন। সমকালিন ব্রাক্ষ্মণগণ দ্বারা সৃষ্ট আদিবাসী প্রধানের নামে বংশ ধারণা গড়ে ওঠার রীতিটি এই অঞ্চলে প্রতিষ্ঠা পায়। পরবর্তীতে বিশ্বসিংহের বংশজাত ব্যক্তিগণ কোচ নাম পরিত্যাগ ক’রে রাজবংশী নাম গ্রহণ করেন।’ জাতীয় অধ্যাপক সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় মনে করেন হিন্দুধর্ম গ্রহণ ও সংযুক্তিকরণ দ্বারা কোচ জনগোষ্ঠীরূপে নিজেদের পরিচয় দিতে শুরু করেন। বুকানন হেমল্টন বলেছেন, রাজবংশী জনগোষ্ঠী পূর্বতন কামরূপেরই আদি জনগোষ্ঠী এবং ভারতের পূর্ব ক্ষেত্রের আদি মানবগোষ্ঠীর সুসভ্য উত্তরাধিকার। এই সকল আদি মানবগোষ্ঠী কোচ ও রাজবংশী সমার্থকরূপে বিবেচিত ছিল। পরবর্তীতে এই জনগোষ্ঠীগুলি নিজেদের জীবনযাত্রা ও সংস্কৃতিতে ভিন্নতা, বিশিষ্টতা অর্জনে সমর্থ হয়।’ বিশিষ্ট গবেষক চারুচন্দ্র স্যান্যাল তাঁর গ্রন্থে লিখেছেন, ‘উৎসগত দিক দিয়ে কোচ জনগোষ্ঠী হ’ল অনার্য জাতিসম্ভূত। হাজো’র পৌত্র বিশ্বসিংহ, তাঁর আধিকারিক ও সমস্ত জনগণ হিন্দুধর্ম গ্রহণ করেন। কোচ নাম পরিহার ক’রে ‘রাজবংশী’ নাম গ্রহণ করেন। The name Rajbansi, which literally means ‘Royel Race’, is adopted by cultivators and respectable man.’         

বিশ্বসিংহ ১৫২২ থেকে ১৫৩৩ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত সিংহাসনে আসীন ছিলেন। এরপর সিংহাসনের দাবিদার হলেন তাঁর তিন পুত্র। নরসিংহ, নরনারায়ণ ও শুক্লধ্বজ। শুক্লধ্বজ ‘চিলা রায়’ নামে অধিক পরিচিত। শুক্লধ্বজ ছিলেন বীর ও সমর বিদ্যায় অত্যন্ত পারদর্শী। কথিত যে তিনি শত্রুপক্ষের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তেন চিলের ক্ষিপ্রতায়। তাই ‘চিলা রায়’ নামে পরিচিত হলেন ইতিহাসে। তাঁকে কোচবিহার ও উত্তরবঙ্গের মানুষ শ্রদ্ধাবনত চিত্তে স্মরণ করেন। বিশ্বসিংহের পর কোচবিহারের সিংহাসনে আসীন হলেন নরনারায়ণ। নরনারায়ণের সিংহাসন প্রাপ্তি সম্পর্কে একটি কাহিনি প্রচলিত। বিবাহের পর নরনারায়ণ সস্ত্রীক আশীর্বাদ প্রার্থনা করে বিশ্বসিংহের চরণ স্পর্শ করতে এলে বিশ্বসিংহ নরনারায়ণের স্ত্রীকে ‘রাজমহিষী ভবঃ’ বলে আশিস জানালেন। বুদ্ধিমতী পুত্রবধূ বললেন, স্বামী সিংহাসন না পেলে আমি কী ক’রে রাজমহিষী হব! তাঁর কথা রাখতেই বিশ্বসিংহ নরনারায়ণের হাতে শাসনভার ন্যস্ত করলেন। বড়পুত্র নরসিংহ তা মেনে নিলেন। নরসিংহ সম্পর্কে প্রখ্যাত গবেষক চারুচন্দ্র স্যান্যাল লিখেছেন, According to Gait, Narasingha seized the throne after Biswa Singha but Naranarayan drove him out and he fled to Bhutan and founded a kingdom there.

একথা আমরা অনায়াসে বলতে পারি বিশ্বসিংহের পুত্রদের মধ্যে সুযোগ্য ছিলেন নরনারায়ন ও শুক্লধ্বজ। বিশ্বসিংহ আঠারোজন মহিলাকে মহিষী রূপে গ্রহণ করেছিলেন। তাঁর সন্তান ছিল আঠারোটি। দরং রাজবংশাবলীতে লেখা হয়েছে

হেমপ্রভা পদ্মাবতী দুই বরনারী

গৌর দেশ মধ্যে তাকে পালাইন্ত বিচারি ।।

হেমপ্রভা হন্তে যিতো পুত্র উতপন

গনিয়া দিলন্ত নাম নরনারায়ণ।।

পদ্মাবতী হন্তে যিটো পুত্র উতপতি

তান নাম শুক্লধ্বজ খেলন্ত সম্প্রতি ।।

কোচেদের মধ্যে এরাই সম্ভবত প্রথম সংস্কৃত ভাষা জ্ঞানী। অত্যন্ত শিক্ষিত এই দু’ভাই পরবর্তীতে কোচবিহারকে উন্নতির শিখড়ে নিয়ে যান। সাহিত্য সংস্কৃতিতেও তাঁদের অনেক অবদান আছে। ১৫৫৫ খ্রিষ্টাব্দে অহম রাজকে লেখা নর-নারায়ণের চিঠিটিই আধুনিক বাংলা গদ্যের প্রথম নিদর্শন হিসেবে স্বীকার করেছেন বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসবিদগন। এখানে চিঠিটি উল্লেখ করছি।

এই পত্রকেই আমাদের পন্ডিতগণ বাংলা গদ্যের সূচনা সাব্যস্ত করেছেন। এই পত্রের সাহিত্যমূল্যও যথেষ্ট।

 

“স্বস্তি সকল দিগন্ত কণতালা স্কাল সমীরণ প্রচলিথি মকর হরহার হাস্কাশ কৈলাস পান্ডূরষ শোরা শিবিরা জিত্ত্রি পিষ্ট পতিদশ তরঙ্গিনী সলিল নির্ম্মল পবিত্র কলেবর ধীষণধীর ধৈর্য্যদা পারাবার সকল দিক্কা মিনীসীয়মান গুণসন্তান শ্রী শ্রী স্বর্গনারায়ন মহারাজ প্রচন্ড প্রতাপেষু।

লেখনং কার্যঞ। এথা আমার কুশল। তোমার কুশল নিরন্তরে বাঞা করি। অখন তোমার আমার সন্তোষসম্পাদক পত্রাপত্রি গতায়ত হইলে উভয়ানুকূল প্রীতির বীজ অঙ্কুরিত হইতে রহে। তোমার আমার কর্তব্যে সে বর্দ্ধিতাক পাই পুষ্পিত ফুলিত হইবেক। আমারা সেই উদ্যোগেতে আছি তোমারও এগোট কর্তব্য উচিৎ হয় না কর তাক আপন জান। অধিক কি লেখিম। সত্যানন্দ কর্মী রামেশ্বর শর্মা কালকেতু ও ধুমা সদ্দার উদ্দন্ড চাউনিয়া শ্যামরাই ইমাক পাঠাইতেছি তামরার মুখে সকল সমাচার বুঝিয়া চিতাপ বিদায় দিবা।

অপর উকিল সঙ্গে ঘুড়ি ২ধেনু ১চেঙ্গা মৎস ১জোর বালিচ ১জকাই ১সারি ৫থান এই সকল দিয়া গইছে। আরু সমাচার বুঝি কই পাঠাইবেক। তোমার অর্থে সন্দেশ গোমচেং ১ছিট ৫ঘাগরি ১০কৃষ্ণচামর ২০শুক্লচামর ১০। ইতি শঁক ১৪৭৭ মাস আষাঢ়।”

বিশ্বসিংহ রাজ্যকে দুটি ভাগে ভাগ করেন। একটি অংশ নরনারায়ণ অপর ভাগ পেলেন শুক্লধ্বজ। রাজ্যের পশ্চিম ভাগ ছিল নরনারায়ণের যা সংকোশের উত্তর থেকে মহানন্দা পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। শুক্লধ্বজের অংশে পড়েছিল সংকোশের পূর্বভাগ। শুক্লধ্বজ ছিলেন অসাধারণ নির্ভিক ও বীর যোদ্ধা। তিনি তড়িদ্গতিতে শত্রুরাজ্য জয় করতে পারতেন। অসম রাজ্যের সঙ্গে যুদ্ধের সময় ঘোড়ার পিঠে চেপে ‘চিলের’ মত লাফ দিয়ে ধরলা নদী পার হয়েছিলেন বলে তাঁর নাম চিলা রায় হয় বলে প্রচলিত। ঐতিহাসিক টয়েনবি আধুনিক ইতিহাসের যে তিনজন বীরের উল্লেখ করেছেন তাঁদের একজন শুক্লধ্বজ। অন্য দুজন নেপলিয়ন বোনাপার্ট ও ছত্রপতি শিবাজী।

বিশ্বসিংহ দুইভাইকে দুই অংশের দায়িত্ব দিলেন বটে, কিন্তু রাজ্যের রাজা ছিলেন নরনারায়ণ। চিলা রায় হলেন রাজ্যের সমরকুশলী সেনাপতি। চিলা রায়ের সঙ্গে যুদ্ধে পরাজিত হয়ে মনিপুর, জয়ন্তিয়া, ত্রিপুরা, শ্রীহট্টের রাজারা বশ্যতা স্বীকার করেছিলেন। কোচবিহার এই সময়েই বিরাট রাজ্যে পরিণত হয়। পূর্বে বর্মার সীমান্তবর্তী এলাকা থেকে পশ্চিমে ত্রিহুত এবং উত্তরে তিব্বত থেকে দক্ষিণে ঘোড়াঘাট পর্যন্ত রাজ্যের সীমানা বিস্তৃত হয়েছিল। ‘নারায়ণ’ নামে সোনা ও রূপার মুদ্রা প্রচলন করেন নরনারায়ণ। এই মুদ্রা সমগ্র পূর্বভারতে এবং ভূটানে প্রচলিত ছিল। কিন্তু বিশাল এই রাজ্য খুব বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। সপ্তদশ শতাব্দি থেকেই কোচ রাজ্যের অবনতি ঘটতে শুরু করে।

চিলা রায়ের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র রঘুদেব রাজ সিংহাসন দাবি করেন। নরনারায়ণের জীবদ্দশাতেই রাজ্য বিভক্ত হয়ে যায়। দুটি পৃথক রাষ্ট্রে পরিণত হয়ে নিজেদের মধ্যে কলহে জড়িয়ে পড়ে। বাইরের আক্রমণে বিধ্বস্ত হয়ে যায়। মুঘল ও অসম রাজের দু’পাশ থেকে প্রবল আক্রমণ কোচরাজ্য প্রতিহত করতে পারেনি। অপর দিকে ভুটান রাজের সঙ্গেও সমস্যা তৈরি হয়। ওদিকে বৈকুন্ঠপুর পৃথক রাজ্যরূপে নিজেদের স্বাধীনতা ঘোষণা করে। মহারাজ মোদনারায়ণের সময় কোচবিহার ভুটানের অধীনে চলে যায়। মাঝে তা উদ্ধার করা সম্ভব হলেও মহারাজ ধৈর্যেন্দ্রনারায়ণের  সময়  কোচবিহার পুনরায় ভূটানের অধীনে চলে যায়। এরপর রাজেন্দ্রনারায়ণ নামেই রাজা থাকেন, সমস্ত ক্ষমতা থাকে ভুটান রাজের হাতে। রাজেন্দ্রনারায়ণ ভরণপোষণ পেতেন।

এরপর কোচেরা গোপনে ইংরেজদের সঙ্গে আরক্ষা চুক্তি করে। ইংরেজদের সহায়তায় রাজ্য পুনরুদ্ধার হয়। কিন্তু তা ইংরেজদের করদ রাজ্যে পরিণত হয়। এর সাথেই চারশো পঞ্চাশ বছরের স্বাধীন সার্বভৌম এবং শক্তিশালী রাজতন্ত্রের অবসান ঘটে। ইংরেজদের করদ রাজ্যরূপে ধৈর্যেন্দ্রনারায়ণ, হরেন্দ্রনারায়ণ, নরেন্দ্রনারায়ণ, নৃপেন্দ্রনারায়ণ, রাজেন্দ্রনারায়ণ, জিতেন্দ্রনারায়ণ, রিজেন্সি কাউন্সিল এবং জগদ্দীপেন্দ্র নারায়ণ সিংহাসনে আসীন ছিলেন।

১৯৪৯ খ্রিষ্টাব্দের ১২ সেপ্টেম্বর কোচবিহার ভারত ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত হয়। ভারত সরকারের আদেশক্রমে রাজন্যভাতার বিলোপ ঘটে। ১৯৫০ সালের ১ জানুয়ারি কোচবিহার পশ্চিমবঙ্গের জেলা হিসেবে অন্তর্ভূক্ত হয়। স্বাধীন রাজতন্ত্র হিসেবে ১৫১০ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ১৭৭৩ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত মোট ২৬৩ বছর এবং করদ মিত্র রাজ্য রূপে ১৭৭৩ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ১৯৪৯ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত মোট ১৭৬ বৎসর, সব মিলিয়ে চারশো চল্লিশ বছরের কোচ রাজতন্ত্রের অবসান ঘটে। কোচ রাজাদের প্রত্যেকেই ছিলেন প্রজাবৎসল, সংস্কৃতিপ্রেমী ও ধর্মপরায়ণ। বিভিন্ন সময়ে তাঁরা কোচবিহারের নিজস্ব সংস্কৃতি প্রসারের উদ্যোগ নিয়েছেন।     

কোচ রাজতন্ত্র বর্ণময় ও ঘটনাবহুল। প্রায় সাড়ে চারশো বছরের বিস্তৃত ইতিহাস অত্যন্ত আকর্ষণীয়। সে সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত এই আলোচনা জেলাটি সম্পর্কে একটি ধারণা নির্মাণের উদ্দেশে। আগ্রহীরা এ সম্পর্কে বিস্তৃত জানতে চাইলে ‘কোচবিহারের ইতিহাস’ পুস্তকটি সংগ্রহ করতে পারেন। অত্যন্ত সুন্দর ও নির্ভরযোগ্য এই কেতাবটি রচনা করেছেন ঐতিহাসিক আমানাতুল্লা আহমেদ। এবার আমরা প্রবেশ করবো কোচবিহারের লোকনাট্য বিষয়ক আলোচনায়।

কোচবিহারের লোকনাট্য রচনাশৈলি ও উপস্থাপনায় প্রাচীনত্বের দাবি রাখে। কুশান পালাগান, বিষহরি, দোতরাদাঙা, সাইটল, চন্ডিনাচ, কাতিপূজার গান ছড়িয়ে আছে সারা কোচবিহার জেলায়। দিনহাটার কুশান পালাগান তো অনবদ্য। আছে হুদুম দেও, জঙগান ইত্যাদি। লোকনাট্যগুলি সাধারণ মানুষের পাশাপাশি বিদগ্ধ জনকেও মুগ্ধ করে।

(এরপর আগামী সংখ্যায়)

এই সংখ্যার সূচী

করোনা কালের প্রতিবেদন ফ্রি রিডিং

Disclaimer: Few pictures in this web magazine may be used from internet. We convey our sincere gratitude towards them. Information and comments in this magazine are provided by the writer/s, the Publisher/Editor assumes no responsibility or liability for comments, remarks, errors or omissions in the content.
Copyright © 2025. All rights reserved by www.EkhonDooars.com

Design & Developed by: WikiIND

Maintained by: Ekhon Dooars Team