রোজ সকালে মর্নিং ওয়াক, থুড়ি মর্নিং ফ্লাইয়ে বেরিয়ে এক ঘুঘু দম্পতি আমার ব্যালকনিতে জিরোতে আসেন৷ আমার পুত্রদ্বয় আবার ভারি অতিথিবৎসল। সকাল সকাল অতিথি এসে খালি মুখে ফিরে যাবে, তাও কি হয়? সুতরাং পুত্রেরা এবং তাদের বাবাটি বাটিতে করে চাল-ডাল যা হোক বেড়ে দেয় তাদের সামনে। আমি বাপু অত পক্ষীপ্রেমী নই। আমার সোজা হিসেব হল, পাখির জন্য খোলা আকাশ আছে, খেতে শস্য আছে, গাছে ফল-পাকুড় আছে, পোকামাকড়ের তো অভাব নেইই। তারা সর্বচরাচরেই বিদ্যমান। সুতরাং এই ঘুঘুদের ঘরে ডেকে অত আহ্লাদ দেখানোর আছেটা কী?
তা আমার কথায় পিতাপুত্ররা কেউ কোনোদিনই কান দেন না বিশেষ। মাকে রীতিমত হৃদয়হীনা বলেই ঠাউরে নিয়েছে আমার গর্ভজাতরা। তাদের বাবাটি আরও এক কাঠি সরেস। তার মতে আমি নাকি এই হোমফ্রন্টের হিটলার। যাক গে বলুক গে। তাতে আমার বয়েই গেল। ওরা তো আদর দেখিয়ে খাইয়েই খালাস। তারপরে আমার ব্যালকনিটিকে পক্ষীযুগল পাবলিক টয়লেট বানিয়ে হোয়াইটওয়াশ করে দিয়ে যায়, তার বেলা? সেগুলো পরিষ্কার করতে তো আমাকেই হয়। কই তখন ছেলেদের কিংবা তাদের বাবার টিকির দেখা মেলে না!
কদিনের জন্য গেছিলাম বাপের বাড়ি, বাবার জামাইটিকেও সঙ্গে নিয়েছিলাম। দিন দশেক পরে ফিরে এসে দেখি ব্যালকনিতে ওয়াশিং মেশিনের কোণে ঘুঘু দম্পতি দিব্যি খড়কুটো দিয়ে বাসা বানিয়ে অ্যাক্কেরে জমিয়ে বসেছে। বা রে, মরি মরি! খাসা বন্দোবস্ত! যাকে বলে ফুডিং লজিং এক্কেরে ফ্রি! চেঁচিয়েমেচিয়ে এদের প্রশ্রয়দাতা ভদ্রলোককে ডাকলাম। তিনি দেখে মিনমিন করে বললেন, "এ বাবা! কষ্ট করে বাড়ি করেছে। তাড়িয়ে দেবে?"
আমিও গভীর গহন ভ্রূকুটি করে উত্তর দিলাম, "তাড়াব না মানে? আলিবাৎ তাড়াব! আনপারমিটেড ট্রেসপাসের মামলা করব। হতচ্ছাড়া বদমাস! এ কী অসভ্যতা! ঘাঁটি গেড়ে বসার আগে মিনিমাম পারমিশনটুকু নেবে না ? এসব আমি মোটেই বরদাস্ত করব না।"
রেগেমেগে উৎখাত করতেই গিয়েছিলাম বিশ্বাস করুন। আমি শক্ত ঘাঁটি, হুঁ হুঁ বাবা, আমার সঙ্গে অত আহ্লাদ নেই। কিন্তু উঁকি মেরে দেখি, শুধু তো স্বামী স্ত্রীর যুগল সংসার নয়, রীতিমতো মেটারনিটি হোম বানিয়ে বসেছে দুটিতে। তাদের খড়কুটোর সংসারে দেখি ক্ষুদে ক্ষুদে তিনখানা ডিম সাজানো। ও হরি, এই ছিল তবে মনে? এবার কী করি? শত হলেও আমিও তো মা। এই অবস্থায় তাড়াই কীভাবে? আমার কত্তাটি বললেন, "আহা থাক! কদিন আর থাকবে? বাচ্চা একটু বড় হলেই উড়ে যাবে।"
রাগ করে লাভ নেই জানি। তবু রাগ হয় কি না, বলুন? একে তো বাড়িতে নিজের দুইখানি ছানা ও সঙ্গে শাশুড়ির ধেড়ে ছানাটিকে পুষতে প্রাণান্তকর দশা। তার উপরে আবার পাখির ছানা! মনে মনে গজগজ করতে থাকি। আমার ছেলেদুটি সারাদিন পাখির বাসার সামনে চোখ গোলগোল করে বসে আছে, তাদের টেনে ঘরে আনা দায় হয়েছে। লেখাপড়া ডকে উঠেছে। দুপুরে খাওয়াদাওয়ার পর মনে হল, ঘুঘু গিন্নী সবে ডিম পেড়েছে। আমার নিজের ছেলেরা জন্মানোর পর জানি তো শরীর কেমন দুর্বল ছিল। বেচারি আদৌ কি কিছু খেল?
আমার হয়েছে যত জ্বালা। বাটিতে করে ডাল-চাল মিশিয়ে দিয়ে এলাম ওদের বাসার সামনে। আঙুল তুলে চোখ পাকিয়ে বললাম, "খবরদার যদি ব্যালকনিতে পটি করেছিস, তোদের একদিন কি আমার একদিন!"
ওরা চোখ পিটপিট করে শুনল, কী বুঝল কে জানে! ঘন্টাখানেক পরে দিবানিদ্রা সেরে গিয়ে দেখি ওয়াশিং মেশিনের ঢাকনার উপর যথারীতি পক্ষীবিষ্ঠার আলপনা।
এভাবেই কাটল কটা দিন। এক সকালে গিয়ে দেখি দুটো ডিম ফুটে দুটো লিকপিকে ছানা বেরিয়েছে। আমি যেতেই মা ঘুঘুটি ঘাড় বাঁকিয়ে সুচিত্রা সেন স্টাইলে তাকাল। মা হয়ে ভারি অহংকার হয়েছে মেয়ের। আমার কত্তাটি আবার সেদিন রাতের ফ্লাইটে অফিসের জোয়াল কাঁধে বিলেত যাচ্ছেন। মনটা একটু ভার ছিল। ব্যালকনিতে চুপচাপ দাঁড়িয়ে দেখছিলাম ঘুঘুদম্পতিকে। পুরুষ পাখিটি বারবার উড়ে গিয়ে কোথা থেকে যেন মুখে করে মটর ডালের দানা নিয়ে আসছে, আর স্ত্রীর মুখে গুঁজে দিয়েই উড়ে যাচ্ছে।
কখন আমার একযুগের বেশি পুরনো সঙ্গীটি পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে টের পাইনি। কাঁধে হাত রাখতে পিছু ফিরে দেখলাম, সেও পাখির সংসারই দেখছে। আমার মুখের দিকে চেয়ে নীরবে হাসল। সেই মুহূর্তে মনে হল এই নির্ভরতাটুকুর চেয়ে দামী আর কিছু নেই। পাখিদের খড়কুটোর বাসাতেই হোক, বা আমার ফ্ল্যাটের চার দেওয়ালের ভিতর, এই উষ্ণতাটুকুই দুজনকে বাঁধে, গড়ে তোলে সংসার।
সে বলল, "কী দেখছ?"
উত্তর দিলাম, "ওদের।"
সে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে নিজেও ওদের দিকে তাকিয়ে রইল। একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল আমার বুক থেকে। বললাম, "দেরি ক'রো না। তাড়াতাড়ি ফিরে এসো।"
সে হাসল। হাসি সংক্রামক। তাই উপচে পড়া অশ্রুটুকু হাতের পিঠ দিয়ে মুছে হেসে বললাম, "ততোদিন আমি বরং এই ছানাগুলোর নার্সিং করে কাটিয়ে দেব। তুমি যখন ফিরবে, ততদিনে ওরা ঠিক উড়তে শিখে যাবে দেখো।"
Have an account?
Login with your personal info to keep reading premium contents
You don't have an account?
Enter your personal details and start your reading journey with us
Design & Developed by: WikiIND
Maintained by: Ekhon Dooars Team