১৯৮৮-র নেহেরু গোল্ডকাপ একটা শহরকে আমূল নাড়িয়ে দিয়ে গেল। চলনে কথনে যে শহরের গায়ে লেগে ছিল মফস্বলী কায়দাকানুন তার বদলে গায়ে উঠল কর্পোরেটের নামাবলি। নির্জন অলস দুপুরের মতো ঝিমিয়ে ছিল যে শহর তা হয়ে গেলো ভীষন ব্যস্ত একটা হল্টিং স্টেশন! বদল হতোই তবু, এতটা যে বিস্ময়ের রেশ কাটে না মেঘকন্যা কাঞ্চনজঙ্ঘার। হবে না কেন? ছিল তিলক ময়দান। হলো কাঞ্চনজঙ্ঘা ক্রীড়াঙ্গন। সে কি তাহলে কসমোপলিটন? দ্বিতীয় কলকাতা! ইস্… একটুর জন্য বড় বেশি মিস্ হয়ে গেলো। গোল হতে হতেও হলো না! পাড়া আর টুকরো টুকরো ফেলাট হাটবাজার এবং শপিং মল এসব নিয়ে সে শহর 'দ্বিধা থরোথরো' হয়ে রইলো আজও।
হাতি মোড়ের চৌমাথায় এসে অদ্ভুত একটি লোকের সঙ্গে দেখা হয়। বলা যায়, আচমকা উদয় হন তিনি যেন মাটি ফুঁড়ে। লোকটা বিড়বিড় করে যা বলে সে তো ফেলে আসা শহরের কথাই। শহরে লোকটা অপরিচিত নন দেখলাম, ...কেউ কেউ পথে যেতে যেতে বলে গেলেন ..আরেহ্, পরিতোষদা!! এই তো সেই পুরোনো পাড়ার আলাপী মেজাজ! আমিও চিনে নিই, লিভিং লিজেন্ড… মুখে মুখে তৈরি হয় গল্প আর হেঁটে চলে বেড়ায় স্মৃতি! শুধু তিনিই বা কেন অরবিন্দ পল্লী দিয়ে হেঁটে আসার সময় পিছন পিছন গল্প হেঁটে আসে। তিলক ময়দানে আর পুরোনো ক্লাব কালচার আলাপ চলে দুই মাঝবয়সীর। আহা, কী সব দিন ছিল! সামনে থেকেও এ গল্পের ভাগিদার হই আমি। আমি, আমরা যারা দেখে দেখে বড় হয়েছি শহরটাকে তাদের আর শহরটাকে তখন হল্টিং জংশন মনে হয় না। আমাদের আর নিছক ট্রাভেলার্স হওয়া হয় না। আমাদের তখন উজ্জ্বল, উচ্ছল শহরের তলায় যে ঘুমন্ত শহরের খোঁজ নিতে ইচ্ছে করে। ইচ্ছে করে মেঘপিওনের যে চিঠি খোলা হয় নি, অনেকদিন তা খুলে দেখতে। এজন্যই তো এগিয়ে যাওয়া, তাই না! ইতিহাস কথা না কইলে বর্তমান আর ভবিষ্যত দুটোই কেমন পানসে হয়ে যেতে থাকে না?
হ্যাঁ, যে কথা হচ্ছিল। সেই তিলক ময়দান আর নেহেরু গোল্ড কাপ। ১৯৮৮এর ১২ই জানুযারি তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু পঁয়তিরিশ হাজার দর্শক আসনবিশিষ্ট কাঞ্চনজঙ্ঘা ক্রীড়াঙ্গনের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন। তারও আগে অবশ্য এর ভিত্তি স্হাপন হয় ১৯৮৫ সালে। এখানেই ১৯৮৮ সালে ১৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত হয় সপ্তম নেহেরু গোল্ড কাপ। ৪ঠা ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত ফাইনাল ম্যাচে জয়ী হয় রাশিয়া। সেই প্রথম একসঙ্গে এত বিদেশিদের আগমন-- সেই প্রথম উত্তেজনার পারদ এক লাফে দেশ বিদেশের সীমানা অতিক্রম করে। কাঞ্চনজঙ্ঘা ক্রীড়াঙ্গন দেখভালের দায়িত্ব শিলিগুড়ি মহকুমা ক্রীড়া পরিষদের হাতে। সংলগ্ন অংশে রয়েছে ক্রীড়া ও যুবকল্যাণ বিভাগের একটি দপ্তর। সাই (Sports Association of India)এর একটি প্রশিক্ষণ দপ্তর। অন্য পাশে একটি স্পোর্টস মিউজিয়াম আর তার চেয়ে সামান্য দৃরে আছে একটি সুইমিং পুল, যেখানে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। কাঞ্চনজঙ্ঘা ক্রীড়াঙ্গনের সম্মুখভাগে একটি পূর্ণাবয়ব মৃর্তি আছে প্রখ্যাত ফুটবলার গোষ্ঠ পালের। আর সাই এর বিল্ডিং থেকে সামান্য এগিয়ে রয়েছে পানু দত্ত মজুমদারের মূর্তি। শিলিগুড়ির অন্যতম ক্রীড়াপ্রেমী পানু দত্ত মজুমদারকে স্মরণ করে নিজ শহরের ঐতিহ্যের প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপন মহনীয় করেছে শিলিগুড়ির সংস্কৃতিকে।
আশির দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত এটাই ছিল তিলক ময়দান। জনপ্রিয় তিলক বাহাদুর শাস্ত্রীর দান করা জমি স্কুলের ছেলেদের খেলার অবারিত জায়গা ছিল। সেখানেই হতো ঈদের নামাজ, রাজনৈতিক এবং সামাজিক জমায়েত। এখানেই স্হানীয় ও আঞ্চলিক ক্লাব ফূটবল ম্যাচ হতো আর ইষ্টবেঙ্গল মোহনবাগানের ম্যাচও। সে সময় মাঠ ছিল বেওয়ারিশ ঘাসে ঢাকা, দুধারে কাঁচা রাস্তা, খানাখন্দ আর ছিল বড় বড় গাছ। দুপাশে ছিল রেল কোয়ার্টার আর ছিল পটুয়াটোলা। বাঁশের কঞ্চির ঝাঁপ ফেলা দোকানে চমৎকার বিক্রি হতো মাটির পুতুল। সেসব কিন্তু মোটেও কৃষ্ণনগরের না, বরং লোকাল মেইড অনেকটাই। ইতিমধ্যে অমিতাভ্ বচ্চন-এর 'অনুসন্ধান' ছবি হিট... বাড়তি পাওনা মাথায় ঝুঁড়ি আর প্রথাগত নেপালি পোশাক পরিহিতা পুতুল, যার পাতানো নাম আমাদের ভাষায় ‘ফুলকলি'!
রাজনীতির চক্রবৎ নানা পরিবর্তনে ইতিমধ্যে শিলিগুড়ি চলে এসেছিল শিরোনামে। একটুও না বাড়িয়ে বলা যেতে পারে, এর আগে অবধি দক্ষিণবঙ্গের সাধারণ বাঙালির কাছে শিলিগুড়ি আর দার্জিলিং ছিল প্রায় সমার্থক। শিলিগুড়ির আলাদা অস্তিত্ব তেমন স্বীকার্য ছিল না।১৯৮৬ তে শুরু হলো সুবাস ঘিসিং-এর আন্দোলন, এবং গঠিত হলো গোর্খা ন্যাশনাল লিবারেশন ফ্রণ্ট বা জিএনএলএফ। ১৯৮৮র ভিসেম্বর মাসে তৈরি হয়েছিল গোর্খা পার্বত্য পরিষদ বা জিটিএ। একই সঙ্গে শিলিগুড়িতে গঠিত হয় শিলিগুড়ি মহকুমা পরিষদ। অর্থাৎ ১৯৮৮ আক্ষরিক অর্থেই শিলিড়ির জন্য খুব তাৎপর্যপূর্ণ একটি বছর, বাঁক বদলের বছর বলেও একে চিহ্নিত করা যেতে পারে।এই বদল শিলিগুড়িকে ক্রম পরিণতি দিয়েছে বাণিজ্যিক শহর হিসেবে। বস্তুত, কাউকেই সে ফেরায় নি। বরং, বহূজনকে আপন করে জনহিতার্থে রিক্ত হয়ছে অনেক। বেড়েছে যানজট, দূষণ। লোকসংখ্যা বাড়ার কারণে শহর ছড়িয়ে গেছে মাটিগাড়া এমনকি আরো দূরে বেড়েছে প্রশাসনিক দায়। হারিয়ে ফেলেছে নিজস্বতা। ঝলমলে আলোর বাইরে কখনও সে যেন বড় রিক্ত, বড় বেশি শূন্য।
শিলিগুড়ি শহর যাদের কাছে একটা করিডর মাত্র--একট সেতু… টার্গেটের দিকে যেতে যেতে তারা একবার পিছন ফিরে তাকাবেন। দেখবেন, দিন বদলালেও সব চরিত্রের বদল হয় না। সব চরিত্র কাল্পনিকও হয় না। আলোকিত প্রশস্ত রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় ভেবে দেখবেন, উজ্জ্বল আলোর স্রোতের বাইরে, পরিবর্তনের সাক্ষ্য নিয়ে কেমন নির্জন, কেমন নির্বাক হয়ে রয়েছে একটা শহর… দেখতে পাবেন শুধু হুজুগের বাইরেও, কেমন করে জেগে আছে প্রাণবন্ত একটি গোটা শহর! সেই শহর আমার শহর আমাদের শহর-- শিলিগুড়ি!
(ক্রমশ)
Have an account?
Login with your personal info to keep reading premium contents
You don't have an account?
Enter your personal details and start your reading journey with us
Design & Developed by: WikiIND
Maintained by: Ekhon Dooars Team