শুনতে অবিশ্বাস্য মনে হলেও কথাটি সত্য ও বাস্তব। ডুয়ার্স-তরাই-দার্জিলিং সহ সমগ্র নেপাল অঞ্চলে বসবাস করেন, এমন একটি জনগোষ্ঠীর মানুষ – যাদের সমাজে নারীরা স্বামী মারা যাওয়ার পরেও বিধবা হয় না, পরতে হয় না বিধবার পোশাক।
কোন সম্প্রদায়ের মধ্যে এই প্রথা প্রচলিত?
এই প্রথা প্রচলিত রয়েছে নেপালি সম্প্রদায়ের ‘নেওয়ার’ সমাজের মধ্যে। প্রাচীনকাল থেকেই নেওয়ার সম্প্রদায় নেপালে বসবাস করে আসছে। নেপালের কাঠমান্ডু উপত্যকার আদি বাসিন্দা হিসেবে পরিচিত এই নেওয়ার সম্প্রদায়। তবে এদের উৎস বা উৎপত্তি সম্পর্কে তেমন কিছু জানা যায় নি। অনেকের মতে এরা প্রাচীন কালে দক্ষিণ ভারত থেকে নেপালে প্রবেশ করেছে। আবার অনেকের মতে এরা তিব্বত প্রদেশ থেকে নেপালে এসেছে। কিরাত এবং লিচ্ছবিদের সাথে এদের সম্পর্ক অস্বীকার করা যায় না। আবার অনেক গবেষকদের মতে – নেওয়াররা প্রাগৈতিহাসিক আমল থেকেই নেপাল উপত্যকায় বসবাস করে আসছে। তবে একথা বলা যায় নেওয়াররা একটি স্বতন্ত্র পার্বত্য জাতি। এদের নিজস্ব ভাষা, লিপি, সাহিত্য এবং রীতিনীতি রয়েছে। উত্তরবঙ্গের দার্জিলিংসহ অন্যত্র যে প্রধান সম্প্রদায়কে আমরা দেখি তারা আসলে নেপালের প্রাচীন জনগোষ্ঠী ‘নেওয়ার’ জাতির অন্তর্ভুক্ত। মূলত এরা প্রধান পদবী ব্যবহার করলেও অনেকে ‘শ্রেষ্ঠা’ পদবীও ব্যবহার করে। নেওয়ারদের মধ্যে নেওয়া, নেপা তথা নেপাল পদবীও দেখা যায়।
নেওয়াররা শিল্পী, স্থপতি, ভাস্কররূপে যেমন দক্ষ তেমনই ব্যবসায়ী রূপেও পরিচিত। হিমালয়ের পাদদেশে চারদিকে এদের ব্যবসাবাণিজ্যের দক্ষতা প্রকাশ বিশেষ ঈর্ষার কারণ। ধাতু ও কাঠের কাজেও এরা পারদর্শী। এদের সাথে যেমন ব্রাহ্মণ, ছেত্রিদের মিল নেই, তেমনই রাই, মগর, লিম্বুদের সাথেও এদের পার্থক্য রয়েছে। হিন্দু ও বৌদ্ধ উভয় ধর্মের প্রভাবই রয়েছে এদের উপর। দুই ধর্মকেই এরা মান্য করেন। একথা অবশ্যই বলা যায় যে, নেওয়াররা শহুরে সংস্কৃতির ধারক ও বাহক। কাঠমান্ডু শহর গড়ার ক্ষেত্রে অবদানকে যেমন অস্বীকার করা যায় না, তেমনই দার্জিলিং শহর গড়ে তোলার ক্ষেত্রেও এদের ভূমিকার কথা ভোলা যায় না।। বলা বাহুল্য এদের সাবেক পোশাকই দার্জিলিং এবং নেপালে সর্বসাধারণের পোশাক হিসেবে গণ্য হয়। ভোট-বর্মীয় ভাষার অন্তর্গত হলেও নেওয়ারি ভাষার উপর সংস্কৃত ভাষার প্রভাব লক্ষ্য করা যায়, তিব্বত-বর্মেলী ভাষার সাথে ধ্বনিগত মিল পাওয়া যায়। একসময় প্রাচীন নেওয়ারি ভাষায় অনূদিত হয়েছিল প্রচুর মহাযান বৌদ্ধশাস্ত্র।
কেন নেওয়ার নারীরা বিধবা হয় না?
নেওয়ার সমাজে এক বিশেষ ধরণের বিবাহ প্রথা চালু আছে, যা ‘বেল বিবাহ’ বা ‘সুবর্ণ কুমার বিবাহ’ নামে পরিচিত। নেওয়ার জাতির জীবনে বেলের মহত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। নেওয়ার জাতির মানুষ বেলকে বিষ্ণুর প্রতীক বলে মনে করে। সেইজন্য নেওয়ার রীতিতে মেয়েদের প্রথমে বেলের সঙ্গে বিয়ে হয়, তারপর স্বাভাবিক মনুষ্য বিবাহ হয়। তাদের মতে যেহেতু ভগবান বিষ্ণু অবিনশ্বর ও অমর, সেইজন্য নেওয়ার মেয়েরা কখনো বিধবা হয়না।
কীভাবে হয় এই বেল বিবাহ বা ‘বেল বিয়া’?
পাঁচ থেকে দশ বছর বয়সী নেওয়ার কন্যাদের বেল-বিবাহের রীতি রয়েছে। এই বেল-বিবাহ ধনী নেওয়ার বা পুরোহিত ডেকে বাড়িতে স্বাভাবিক বিয়ের মতই সমস্ত প্রথা মেনে করে থাকেন। ভগবানকে সাক্ষী রেখে বংশানুগত কুলপিতাকে ভক্তি করে যপ-তপ-মন্ত্র উচ্চারণ করে এই বেল-বিবাহ হয়ে থাকে। বেল-বিবাহ একা কোনও মেয়ের সাধারণত হয় না। গ্রামে সবাই একত্রিত হয়ে সব নেওয়ার মেয়েদের সম্মিলিতভাবে বেল-এর সাথে বিয়ে দেওয়ার পরম্পরা বজায় রাখা হয়। বেল বিবাহের পরে মেয়েরা আজীবন রাতে নিজেদের ঘরে বেল রাখে। বেলের খোসা কঠিন হওয়ার জন্য এই ফল নষ্ট হওয়ার ভয় কম থাকে। এমনকী স্বাভাবিক বিয়ের পরে মেয়েদের স্বামীর ঘরেও সযত্নে বেল রাখার প্রচলন আছে। তাই কোনও কারণে স্বামীর মৃত্যু হলেও তাকে হিন্দু সমাজের মতো বিধবা বলা যায় না বা বিধবা পোশাক পরানো হয় না। নেওয়ার কন্যা পিতৃগৃহে ঋতুমতী হওয়ার আগেই তাকে বেল-বিবাহ দিয়ে পূণ্যার্জনের এই রীতি আজও গুরুত্ব সহকারে প্রচলিত আছে।
(বেল বিবাহ রীতির ছবি ইন্টারনেট থেকে নেওয়া)
Have an account?
Login with your personal info to keep reading premium contents
You don't have an account?
Enter your personal details and start your reading journey with us
Design & Developed by: WikiIND
Maintained by: Ekhon Dooars Team