আগুন ব্যবহারের দক্ষতা অর্জনের মতই জোট বাঁধা মানুষের আর একটি মহৎ ও গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ। কারণ বুদ্ধির বিকাশে গোষ্ঠী জীবনের বড় ভূমিকা রয়েছে। দলগত পরিচয়ের সুফল অচিরেই প্রকাশ পেতে শুরু করলো। একসঙ্গে থাকবার আভিজাত্য টিকিয়ে রাখার জন্য তৈরি হলো কিছু নিয়ম ও জীবন যাপনের পদ্ধতি। গোষ্ঠী ব্যবস্থায় থেকে সেগুলি মেনে চলা ছিল মর্যাদাপূর্ণ অধিকার। প্রতিষ্ঠা পেল সমাজ ব্যবস্থা। ভয়ে শ্রদ্ধায় ভালোবেসে শুরু হলো পুজো, গড়ে উঠলো সংস্কার। খুব স্বাভাবিক কারণেই ভৌগলিক অবস্থান অনুযায়ী তা স্বতন্ত্র। জীবনচর্যার টানাপোড়েন আর পুজো তাকে ঘিরে গড়ে ওঠা আচার তা থেকেই এলো সংস্কৃতি। আচার পালন ও অবকাশ যাপন আমাদের বুদ্ধি, ভাবনা, মননকে পুষ্টি জোগালো। সময়ের সঙ্গে আমাদের সংস্কৃতি সমৃদ্ধ হলো। পর্বত অরণ্য সমভূমি এক একটি বিশ্বাসের লালন ভূমি হয়ে উঠলো। ভিন্ন ভিন্ন পরিচিতি যেমন পেল তেমনি সে বিশ্বাস একে অপরের সঙ্গে আদান প্রদানও করলো।
‘সংস্কৃতি’ শব্দটির ব্যবহার আমরা করি Culture শব্দের সমার্থক রূপে। Culture শব্দের মূলে রয়েছে লাতিন Cultura শব্দটি। সে আবার প্রাণ পেল লাতিন আর একটি শব্দ Col শব্দ থেকে। এই শব্দটির অর্থ চাষ করা, যত্ন করা বা পূজা করা। Culture-এর বাংলা প্রতিরূপে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ব্যবহার করতেন ‘কৃষ্টি’ শব্দটি। ‘সংস্কৃতি’ শব্দটির সূচনা প্রসঙ্গে একটি ঘটনা রয়েছে। পেয়েছি আচার্য সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের রচনায়। তিনি লিখেছেন, “‘সংস্কৃতি’ শব্দটি Culture বা Civilization অর্থে আমি পাই প্রথমে ১৯২২ সালে প্যারিসে, আমার এক মহারাষ্ট্রীয় বন্ধুর কাছে। Culture-এর বেশ ভালো প্রতিশব্দ বলে শব্দটি আমার মনে লাগে। আমার শব্দটি পেয়ে আমার আনন্দ দেখে একটু বিস্মিত হন, তিনি বলেন যে তাঁরা তো বহুকাল ধরে মারাঠী ভাষায় এই শব্দ ব্যবহার করে আসছেন।
১৯২২ সালে দেশে ফিরে এসে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে এ বিষয়ে আলাপ করি। সংস্কৃতি শব্দটির প্রতি তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণ করি। তিনি আগে থাকতেই এই শব্দটি পেয়েছিলেন কিনা জানি না – সম্ভবত শব্দটি তাঁর অবিদিত ছিল না তবে আমার বেশ মনে আছে Culture-এর প্রতিশব্দ হিসেবে ‘সংস্কৃতি’ শব্দ সম্বন্ধে তিনি তাঁর সম্পূর্ণ অনুমোদন জ্ঞাপন করেন, ‘কৃষ্টি’ শব্দ আর ব্যবহার করা ঠিক হয় না, একথাও বলেন।”
Culture-এর প্রতিরূপ বাংলায় ‘সংস্কৃতি’ শব্দটির খুব বেশি পুরোনো নয় দেখতে পাচ্ছি। সংস্কৃতি থেকে আমরা বিশ্লেষণ করতে পারি কোনও জাতির গভীরে বয়ে চলা ফল্গুধারাকে। ভারতীয় অভারতীয় যেকোনও সমাজ ব্যবস্থায় সংস্কার না থেকে উপায় নেই। মানুষ যেদিন অ-সভ্য বা Uncivilized তখনও ছিল আর এই যে আমরা সভ্য বা Civilized, এখনও দস্তুর মত বিরাজ করছে। তাই জাতির আত্মায় তার নিজের সাপেক্ষে যে সৌন্দর্যবোধের স্রোত সর্বদা বিদ্যমান তা বুঝতে পারি সে জাতির সংস্কৃতি থেকে। সভ্যতা হলো উন্নত মানব সমাজের বহিরঙ্গ, তার উন্নত জীবনযাত্রা, সামাজিক রীতিনীতি, রাষ্ট্রনীতি, রূপশিল্প, বস্তুশিল্প, পূর্ত, তার সাহিত্য, ধর্ম ইত্যাদির মিলিত রূপ। আর কালচার বা সংস্কৃতি বললে বুঝি তার উন্নত জীবনযাপনের অন্তরঙ্গ বস্তুগুলি যেমন আধিমানসিক ও আধ্যাত্মিক জীবন, সামাজিক জীবনের সৌন্দর্যময় প্রকাশ ও তার বোধ। সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায় বলেছেন, ‘সভ্যতা তরুর পুষ্প যেন সংস্কৃতি’।
মানুষ জীবনের পথ চলে সমাজের সমস্যাকে সমাধানের দিকে ধাবিত করতে করতে। এ তার নিরন্তর কর্ম প্রয়াস। ন্যুনতম চাহিদা মিটে গেলে মেলে অবকাশ। সে অবসরে আছে মৈথুন ও নিদ্রা। এই সবকিছু বাদ দিয়ে যে সময় পাই তাই ব্যয় করি জ্ঞান চর্চার জন্য। জীবনকে ঘিরে এতসব বিষয়-আসয় মিলেই গড়ে ওঠে বয়ে চলা সংস্কৃতি।
গোষ্ঠীজীবনে পরিবর্তনের ছোঁয়া এলো ব্যক্তিগত সম্পত্তির প্রভাবে। পৃথক দু’টি শ্রেণি নির্মিত হলো। ধনী গরীবের এই বৈষম্যে সমাজও প্রভাবিত হলো। গ্রাম ও নগরের রূপ গড়ে উঠলো। পেলাম নাগরিক ও গ্রামীণ সংস্কৃতি। সাংস্কৃতিক বিকাশও লক্ষ্য করা গেলো। রূপের তারতম্যে বিভিন্নতা এল। যা ছিল দেবতাকে তুষ্ট করার উপায়, প্রকৃতিকে শান্ত করার গভীর বিশ্বাস, তা থেকে আমরা বিনোদনের সংস্কৃতিও পেলাম। সে সাংস্কৃতিক অন্বয়ে আমাদের মনে বিশ্বাসের বিস্মিত বিকাশ বিস্তৃত হয়। ক্রমশ তার ব্যকরণগত দিক আবিষ্কার হতে লাগলো। জ্যামিতিক নানা রূপ তাকে এনে দিল মার্জিত প্রকাশভঙ্গি। সময়ের সাথে একসময় সংস্কৃতি শব্দটির সঙ্গে জুড়ে গেল ‘লোক’ শব্দটি।
‘লোকসংস্কৃতি’ শব্দটির পরিচয় জানতে গিয়ে ‘লোক’ শব্দটির আভিধানিক অর্থ পাচ্ছি পৃথিবী, সমূহ, মনুষ্য, জন, বর্ণ, জাতি। কাজেকাজেই লোক শব্দটির সঙ্গে জড়িয়ে আছে মানুষ, তার চারপাশের পরিবেশ ও পার্থিব যা কিছু। আর আছে আমাদের কাছের আত্মীয় সূর্য ও প্রিয় চন্দ্রমা। লোকসংস্কৃতি; মানুষের সংস্কৃতি। পৃথিবীর নানা জনজাতির, আদিবাসী সমূহের সংস্কৃতি। আদি ও অকৃত্রিম চর্চা। মানুষের জীবনচর্যা থেকে স্বাভাবিকভাবে উঠে আসা যে সংস্কৃতি। যা পরিচয় দেয় বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠী ও সমাজের। তাদের বিশিষ্ট করে। তার প্রভাবে আমাদের জ্ঞানভান্ডার সমৃদ্ধ থেকে সমৃদ্ধতর হয়ে উঠেছে। শিক্ষাদীক্ষায় পরিপূর্ণ জীবনের দিকে এগিয়ে গেছে মানুষ।
জোট বাঁধার সঙ্গে সঙ্গে প্রয়োজন হয়ে পড়ে কমিউনিকেশনের। একের সঙ্গে অপরের এই সংযোগ সমস্যা সমাধানের রাস্তাকে সহজ করে। সম্পর্ক স্থাপন বা যোগাযোগ সংযোগের মূল উদ্দেশ্য। সম্পর্ক তাৎক্ষিণিক, স্বল্পকালব্যাপী অথবা সুদীর্ঘকালেরও হতে পারে। মানুষের সঙ্গে মানুষের আবার মানুষের সঙ্গে পার্থিব বা অপার্থিব যা কিছু তাদের সংযোগ। একক অথবা গণ সংযোগ। আন্তরিক, বাহ্যিক সংযোগ। জৈবিক ও মানসিক সংযোগ। নিদেনপক্ষে দু’জন না হলে সংযোগের এই রহস্যময় সম্পর্কটা সম্ভব নয়। একজন দাতা অপরজন গ্রহীতা। দাতা আপনাকে দেয়, গ্রহীতা তা গ্রহণ করে। সংযোগের মজাটা জমে ওঠে তখনই যখন দাতা নিজেকে দেয় নিঃস্বার্থ ও নিঃশর্তে এবং গ্রহীতার তা গ্রহণে থাকে না কোনও কুন্ঠা। এমন এক সংযোগই তো গড়ে তোলে সুন্দর এক ব্যবস্থা যা উদ্দেশ্যকে বিস্তৃত করে।
দাতা আত্মানুভূতি নিবেদন করে গ্রহীতা তা গ্রহণ করে। সে যেভাবেই হোক না কেন। দাতা যে আত্মনিবেদন করে, তা না করে তার উপায় নেই। নিজেকে মেলে ধরা বা প্রকাশ করার আকাঙ্খা অনিবার্য। গ্রহীতারও নিস্তার নেই গ্রহণ না করে। সংযোগ দাতা গ্রহীতার এই কাজটিকেই ত্বরান্বিত করে। দাতা-গ্রহীতার উদ্দেশ্য মহৎ। আত্মানুভূতি নিবেদনের উপায় ও ধারকের খোঁজে ফেরে দাতা। গ্রহীতাও থাকে চাতকের ন্যায় উন্মুখ।
সংযোগের উপায় বা মাধ্যম হতে পারে নানা ধরণের। কথোপকথন, চিঠিপত্র, সাহিত্য, সংগীত, নৃত্য, চিত্রকলা, ফটোগ্রাফ, সিনেমা, নাট্য ইত্যাদি। সৃষ্টির সঙ্গে সঙ্গে প্রয়োজন হয়ে পড়ে অন্য একজনের যিনি তা উপভোগ করবেন। নিজের মনকে অন্য আর একজনের সঙ্গে ভাগ করে নেওয়া। আর এ অভিলাষেই সৃষ্টি হলো ভাষা। না, শুরুতেই শব্দ মাধুর্যে পূর্ণ কোনও কমিউনিকেশন স্কিল নয়। হতে পারে অকৃত্রিম অঙ্গভাষা। অথবা শরীরের অর্থবোধক কিছু ব্যবহার ও কিছু ধ্বনি সহযোগে গড়ে ওঠা সংযোগের উপায়। পরে গড়ে ওঠা যার আর একটি বিশিষ্ট রূপ কথ্য ভাষা। সংযোগের আদিরূপ অঙ্গ সঞ্চালনের মাধ্যমে মনের ভাব প্রকাশ। যা বিশ্বজনীনও বটে। সহজ ও অকৃত্রিম। পটুত্ব কোন স্তরের বিচার্য নয়। গুরুত্বপূর্ণ হল তা অন্যের মনে দ্যোতনা নির্মাণ করে কি না। একে অপরকে বুঝতে পারছে কিনা।
অঙ্গ সঞ্চালন ও কথ্যভাষা, এই দুই প্রবহমান চর্চার তন্নিষ্ঠ রূপই হল শিল্প, সংস্কৃতি। যা ভাবের বিনিময় করে। সংযোগের ধারাকে অব্যাহত রাখে। পরবর্তীতে তাই-ই হয়ে উঠল প্রয়োজনীয় ও বিনোদনের উপচার। সময়ের সঙ্গে পেয়ে গেলাম একটি শব্দ ‘লোকসংস্কৃতি’। একটি নাম। সহজে প্রকাশ করবার পরিচয়। আমাদের কাছে বিশিষ্ট এক সাস্কৃতিক ধারার আইডেনটিটি। শব্দটি ব্যবহারে অনেকেই আপত্তি জানান। এই শব্দ ব্যবহারের ঘোরতর বিরোধী বিশিষ্ট নাটককার, গবেষক, জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সেলিম-আল-দীন। তিনি তাকে বলেছেন ‘ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতি’। তবে লোকসংস্কৃতি শব্দটিই অধিক পরিচিত। এই শব্দটি ইংরেজি একটি শব্দের পরিভাষারূপে ব্যবহৃত হয়।
১৮৬৪ সালে উইলিয়ম থম্স নামে এক ইংরেজ পন্ডিত ‘দ্য এথেনিয়াম’ পত্রিকায় ‘Folklore’ শব্দটি প্রথম ব্যবহার করেন। কয়েকজন জার্মান বিশেষজ্ঞ অবশ্য এর বিরোধিতা করেন। তাঁরা বলেন ‘Folklore’ শব্দটি আদতে জার্মান ‘Volkskunde’এর অনুবাদ। যে শব্দটি ইংরেজি ‘Folklore’-এর চল্লিশ বছর আগে ব্যবহার করা হয়েছে। এ নিয়ে বিতর্ক হয়েছে খুব। তবে এটা নিশ্চিত মৌলিক বা অনুবাদ যাই হোক না কেন ইংরেজি শব্দটি থম্সই প্রথম ব্যবহার করেছেন।
বাংলা ভাষায় ফোকলোরের যথার্থ সর্বজন গ্রাহ্য প্রতিশব্দ খুঁজে পাওয়া যায়নি। লোকজান, লোকচর্যা, লোকশ্রুতি, লোকায়ত, লোকবৃত্ত, লোকলোর ইত্যাদি নানা ধরনের শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। বোঝার সুবিধের জন্য একসময় ‘লোকসংস্কৃতি’ শব্দটি চালু হয়ে গে্লো। শব্দটি ব্যবহারেও প্রধান্য পেলো।
আমাদের দেশে লোকসংস্কৃতি চর্চায় ইউরোপীয় মিশনারিরাই অগ্রগণ্য। তাঁদের মধ্যে যাঁর নাম উল্লেখ করা প্রয়োজন, তিনি ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের অধ্যক্ষ উইলিয়াম কেরি। লোকসংস্কৃতি বিষয়ক তাঁর দুটি গ্রন্থ। একটি ‘কথোপকথন’ (১৮০১ সালে প্রকাশিত), এ বইয়ে সংকলন করা হয়েছে চাকর ভাড়া করা, মজুরের কথাবার্তা, ঘটকালি, মেয়েলী কোন্দল, ভোজনের কথা, স্ত্রী লোকের হাট করা ইত্যাদি বিভিন্ন আঞ্চলিক বৈশিষ্টের কথ্য রীতি। অন্য বইটি ‘ইতিহাস মালা’, ১৮১২ সালে প্রকাশিত এই সংকলনে একশ পঞ্চাশটি শিরোনামে গল্প সংগ্রহ করা হয়েছে ভিন্ন ভিন্ন স্থানের। এতে পঞ্চতন্ত্র, হিতোপদেশ, বেতাল পঞ্চবিংশতি ও প্রচুর সংখ্যক বাংলাদেশের গল্প আছে। কেরির সহযোগী শ্রীরামপুর মিশনের রেভারেন্ড উইলিয়ম ওয়ার্ডক খ্রীষ্টধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে গ্রাম-গ্রমান্তরে ঘুরে বেড়াতেন। সে অভিজ্ঞতায় ঋগ্ধ হিন্দুধর্ম ও প্রথা বিষয়ে একখানি গ্রন্থ রচনা করেন। ১৮১১ সালে প্রকাশিত এই গ্রন্থটি ‘Accounts of the writings, Religion and Manners of the Hindoos’।
‘নীলদর্পন’ নাটকের ইংরেজি অনুবাদক জেম্স লঙ ১৮৬২ থেকে ১৮৮১০ সালের মধ্যে লোকসংস্কৃতি বিষয়ক অত্যন্ত মূল্যবান কতগুলি রচনা প্রকাশ করেন। যেমনঃ
জেম্স লঙ ছিলেন উদ্যোমী ও পরিশ্রমী। অনেক ধরণের কাজে তিনি পারদর্শী ছিলেন। প্রচেষ্টা ছিল নতুন নতুন কাজ করবার। লোকসংস্কৃতি বিষয়ে তাঁর এই অনুসন্ধান প্রশংসনীয়।
এই কাজগুলির বহু আগে উইলিয়ম জোন্স সাহেবের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘এশিয়াটিক সোসাইটি’। উদ্দেশ্য, ভারতের পুরাতাত্ত্বিক, নৃতাত্ত্বিক, সমাজতাত্ত্বিক ও ভাষাতাত্ত্বিক গবেষণার সূত্রে লোকসংস্কৃতি চর্চা এবং বিজ্ঞানভিত্তিক বিশ্লেষণ ও পর্যালোচনা। যে কাজের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন কয়েকজন বিশিষ্ট বাঙালি। ১৮৩৮ সালে ডিরোজিওপন্থীদের পরিচালিত ‘জ্ঞানোপার্জিকা সভা’ ১৮৩৯ সালে মহর্ষি দেবেন্দ্র নাথ ঠাকুর পরিচালিত ‘তত্ত্ববোধিনী সভা’, ১৮৯৪ সালে প্রতিষ্ঠিত ‘বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ’ লোকায়ত সংস্কৃতি চর্চায় উল্লেখযোগ্য ভূমিকা গ্রহণ করে।
লোকসংস্কৃতি বিষয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আগ্রহের কথা আমাদের অজানা নয়। তাঁর রচনায় সে পরিচয় আমরা পেয়েছি। তাঁর কিছু গানের সুরেও সে প্রভাব আছে। রবীন্দ্রনাথের জাতীয় পুরাতন সম্পত্তি সংগ্রহ করার আহ্বানে এগিয়ে আসেন বসন্তরঞ্জন রায়, রজনীকান্ত গুপ্ত, অক্ষয় চন্দ্র সরকার, কুঞ্জলাল রায়, অম্বিকাচরণ গুপ্ত, মুনসী আবদুল করিম, দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদার, রামপ্রসাদ গুপ্ত, অক্ষয় চন্দ্র সরকার, হরিদাস পালিত, জীবেন্দ্র কুমার দত্ত – এমন অনেকেই। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রত্যক্ষ প্রশ্রয় ও আগ্রহে সাধনা, ভারতী, বালক প্রভৃতি পত্রিকাগুলিতে লোকসংস্কৃতি বিষয়ক রচনা ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ হতে থাকে। আমরা লক্ষ্য করেছি জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে প্রাচীন ঐতিহ্য ও আধুনিক চিন্তার প্রসার পাশাপাশি লালিত হয়েছে। যার প্রভাব আমদের শিল্প, সংস্কৃতি, জীবনচর্যায় আজও প্রবল।
হিমালয় সংলগ্ন পশ্চিমঙ্গের আটটি জেলার ভৌগোলিক এলাকা উত্তরবঙ্গ নামেই খ্যাত। যার অনন্য বৈশিষ্ট ও স্বতন্ত্র ধারা অতুলনীয় পরিচিতি দিয়েছে। এখানে রয়েছে সমভূমি, অরণ্য ও পার্বত্য অঞ্চল। তাই মনোরম এখানের পরিবেশ ও আবহাওয়া। নদীর সংখ্যাও অনেক। নদী, উপনদী, শাখানদী এ অঞ্চলের মাটিকে করেছে উর্বর। ভারতে প্রবাহিত মানব সভ্যতার সব কয়টি ধারা এই অঞ্চলের ওপর দিয়ে গেছে। যা এই অঞ্চলের একটি বিরল অভিজ্ঞতা। সংস্কৃতিকেও করেছে সমৃদ্ধ ও বহুবিধ ধারায় প্রবাহিত। উত্তরে হিমালয়, দক্ষিণে গঙ্গা, পূর্বে ব্রক্ষ্মপুত্র, পশ্চিমে কোশী নদীর মধ্যবর্তী যে ভূ-খন্ড সে অঞ্চলটি উত্তরবঙ্গ নামে পরিচিত। অর্থাৎ তিনদিকে তিনটি প্রাচীন নদী আর উত্তরের হিমালয় পর্বত মায়ের কোলের নিশ্চিন্ত আশ্রয় দিয়েছে।
আর্যদের আগে দ্রাবিড়, তারও আগে অষ্ট্রিক জনগোষ্ঠী কৃষির বিকাশ ঘটিয়েছে এঅঞ্চলে। কৃষি, কৃষিই মানুষকে শিক্ষা দিয়েছে অনেক। তাকে সাংস্কৃতিকভাবে সম্পন্ন করেছে। সমৃদ্ধ করেছে। অভিজ্ঞতার অভিযোজন ঘটেছে কৃষিকে কেন্দ্র করে। মধ্যপ্রস্তর যুগে ভারতে প্রথম অভ্যাগত মানবগোষ্ঠী নেটিগ্রোরাও এখানে পদচারণা করেছে। আবার দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার আদি প্রস্তর যুগে পিলেকান্থ্রোপাসগণ বিবর্তিত হয়ে হোমো ইরেকটাস বা পূর্ণ মানব, বর্মা থেকে ভারতের মধ্য দিয়ে ইউরোপ ও আফ্রিকা মহাদেশে ছড়িয়ে পড়েছে। প্রাপ্ত নিদর্শন থেকে আমরা অনুমান করতে পারি আদি প্রস্তর যুগের প্রায়-মানবেরা উত্তরবঙ্গের ওপর দিয়ে যাতায়াত করেছে। সে সময়ের যা কিছু প্রামাণ্য তা আমরা পেয়েছি ভারতের চারটি অঞ্চলে। পাঞ্জাব, জম্মু-কাশ্মীর, দাক্ষিনাত্যের মালভূমি থেকে ছোটনাগপুর অঞ্চল পর্যন্ত এবং উত্তরবঙ্গ ও অসমের পার্বত্যময় অরণ্য অঞ্চলে। সারা উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন অঞ্চলে আদি, মধ্য ও নব্য প্রস্তর যুগের নানা উপাদান আমরা পেয়েছি ছড়ানো ছেটানো।
ঐতিহাসিক যুগের শুরুতেই অর্থাৎ ১০০০০ খ্রীষ্টপূর্ব থেকে ৭৫০০ খ্রীষ্টপূর্ব পর্যন্ত সময়ে নেটিগ্রো জাতি প্রবেশ করে। এরা আসে আফ্রিকা থেকে। এদের জীবিকা পশুশিকার ও অরণ্যের ফলমূল সংগ্রহ। জনসংখ্যার চাপে শিকারযোগ্য প্রাণীর পশ্চাদধাবন করতে করতে তারা ভারতে প্রবেশ করে। নেটিগ্রোরা ভারতের পার্বত্যময় অঞ্চল ও মাল্ভূমি জায়গাগুলিতে ছড়িয়ে পড়ে। এদের একটি শাখা আরাবল্লী পর্বতমালা ঘুরে ছোটনাগপুর রাজমহল হয়ে উত্তরবঙ্গে প্রবেশ করে।
নেটিগ্রোদের পর ৭৫০০ খ্রীষ্টাব্দের কাছাকাছি সময়ে ভারতে প্রবেশ করে অস্ট্রিক জনগোষ্ঠী। এরা উত্তরবঙ্গে এসে বাকি ভারতে ছড়িয়ে পড়ে। এরা ছিল যাযাবর শ্রেণী। পরবর্তীকালে অর্থাৎ আনুমানিক ৫০০০ থেকে ৪৫০০ খ্রীষ্ট পূর্বাব্দে এরা চাষবাস শিখে গড়ে তোলে স্থায়ী আবাস। খ্রীষ্টপূর্ব ২০০০ বছর আগে বর্মা সীমান্ত ও ব্রক্ষ্মপুত্র অববাহিকা ধরে অসম ও প্রান্তিক উত্তরবঙ্গে প্রবেশ করে মঙ্গোলীয় জাতি প্রবাহ। এদের আর একটি শাখা তিব্বত হয়ে নেপাল, সিকিম ও ভূটানের পথে উত্তর ভারত ও উত্তরবঙ্গে প্রবেশ করে। এরাই পরে ‘কিরাত’ নামে পরিচিত হয়। প্রান্তিক উত্তরবঙ্গ ও অসমের রাজনীতি, সমাজ গঠন, ভাষা-ভঙ্গী ও সংস্কৃতি মঙ্গোলীয় গোষ্ঠীর প্রত্যক্ষ দান।
এদের পাশাপাশি বিভিন্ন সময়ে আলপানীয় নরগোষ্ঠীর আলপানীয়, দিনারিক ও আর্মেনীয় এই তিনটি শাখা ভারত তথা উত্তরবঙ্গে প্রবেশ করে। এরা এসেছিল মধ্য এশিয়ার পার্বত্য ভূমি থেকে। এদের মধ্যে দিনারিক নরগোষ্ঠীর প্রভাব বাঙালিদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। পরবর্তী সময়ে মঙ্গোলীয়, দ্রাবিড় ও আর্য সংস্কৃতিও গভীর ছাপ ফেলে।
খ্রীষ্টপূর্ব ৪৫০০ বা তার কাছাকাছি সময়ে ভারতে প্রবেশ করে দ্রাবিড় জনগোষ্ঠী। এদের তিনটি ধারা। প্রথম ধারাটি মধ্যম উচ্চতা সম্পন্ন, কৃষ্ণকায় ও লঘু শরীর। এই সম্প্রদায়ের বিচরণ ক্ষেত্র ছিল মূলত দক্ষিণ ভারত। ৩৭০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দে পশ্চিম, মধ্য ও উত্তর ভারতে যে দ্রাবিড় গোষ্ঠী প্রবেশ করে তারা ছিল দীর্ঘ, উজ্জ্বল বর্ণ ও দৃঢ় গঠন। আরও পরে পূর্ব ভারতে ও রাজপুতনা, পাঞ্জাব, সিন্ধু, উত্তর প্রদেশে প্রবেশ করে আর একটি ধারা যাদের উন্নত নাক, গৌরবর্ণ ও দীর্ঘাকৃতি। পূর্ববর্তী অস্ট্রিক গোষ্ঠী ছিল কৃষি কেন্দ্রিক। আর দ্রাবিড়রা নগরকেন্দ্রিক সভ্যতার ধারক বাহক। এদের নাগরিক সভ্যতা ও রাষ্ট্রশক্তির বিকাশ ঘটেছিল দক্ষিণ ভারত, রাজপুতনা, মহেন-জো-দারো ও হরপ্পায়।
খ্রীষ্টপূর্ব দশম শতাব্দীর কাছাকাছি সময়ে আর্যরা ভারতে প্রবেশ করে। এখানে আর্যদের প্রথম আস্তানা গড়ে উঠেছিল সরস্বতী ও দৃশ্যদ্বতী নদীর মধ্যবর্তী অঞ্চলে। এ অঞ্চলে প্রবেশ করেই আর্যরা যে যে রাজশক্তির পরিচয় পেয়েছিল তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য পুন্ডবর্ধন। বাংলার প্রাচীনতম রাজতন্ত্র পুন্ডবর্ধন এই উত্তরবঙ্গের মাটিতেই গড়ে উঠেছিল। শক্তিশালী রাষ্ট্র ও নগরসভ্যতা পুন্ডবর্ধন রাজতন্ত্র শতাব্দীর পর শতাব্দী আর্যদের পূর্বভারতে প্রতিহত করে রেখেছিল। ‘দস্যু’ জাতি নামে পরিচিত ছিল। ‘দস্যু’ শব্দের প্রাচীন অর্থ দেশীয়। আর্যরা রাজ্যবিস্তারের ক্ষেত্রে বাধা পায় উত্তরবঙ্গে। স্বাধীন পুন্ডবর্ধন খ্রীষ্টপূর্ব ১৫০০ থেকে ৩২০ অব্দে গুপ্ত সাম্রাজ্যের পত্তন পর্যন্ত স্থিত ছিল। পরবর্তীতে কণিষ্ক থেকে কিরাত বংশোদ্ভূত অহমরাজ পর্যন্ত অনেক অনার্যগোষ্ঠীই আর্যদের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা সংগ্রাম করে গেলেও তাদের ভাষা, ধর্ম, সামাজিকতা, সংস্কৃতিকে গ্রহন করেছিল। এর অন্যতম কারণ অনার্যদের ক্ষত্রিয় রূপে স্বীকৃতি পাওয়ার জন্য সচেষ্ট হওয়া।
এরপর আমরা চলে যাব একেবারে পাল যুগে। ৭৫০ খ্রীষ্টাব্দে। কেননা বাংলার ইতিহাসে পালযুগ একটা বিশেষ অধ্যায়। প্রাচীন গৌড় (বর্তমানে মালদহ জেলায়)-এ বিভিন্ন সময়ে যে যে শাসন ব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল তাদের মধ্যে শশাঙ্ক, পাল রাজতন্ত্র, সেন বংশে বিশেষ প্রভাব বিস্তার করেছিল। খ্রীষ্টপূর্ব ৩২০ অব্দ থেকে ৭৫০ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত যে ঐতিহাসিক পটভূমি তা পরবর্তী সময়ের ভূমিকা তৈরি করলেও আমাদের আলোচনায় খুব বেশি তাৎপর্য বহন করবে না। উত্তরবঙ্গের মূল জনজাতি রাজবংশী, দেশী, পলি। আছে কিছু আদিবাসী মানুষের বাস ও অন্যান্য জনজাতি। রাজবংশী সংস্কৃতিই এখানে প্রধান। তাই রাজবংশী জনজাতির উৎস খোঁজার চেষ্টা করবো। কেন তাদের রাজবংশী বলা হচ্ছে, এই সংস্কৃতিতে কাদের প্রভাবই বা বিরাজ করছে। এই উত্তর খোঁজার জন্য প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে আলোচনা না করে উপায় ছিল না। যে অংশ এই আলোচনার বাইরে আমরা রাখলাম তার প্রভাব রাজবংশী সংস্কৃতিতে নেই বললেই চলে।
(ক্রমশ)
Have an account?
Login with your personal info to keep reading premium contents
You don't have an account?
Enter your personal details and start your reading journey with us
Design & Developed by: WikiIND
Maintained by: Ekhon Dooars Team