কাঁধে ঝোলা চলল ভোলা। ভোলা পাগলকে দীর্ঘ তিন দশক চেনে এ শহর। শহরের অনেকেই চেনেন, আগে আরও বেশি চিনতেন। এখন কম চেনেন। আগে পাড়া ছিল। হাট বাজারে জমজমাট ছিল শহর। এখন সব জৌলুস শপিং মলগুলিতে। দেওয়ালে লিখে যায় ভোলা, অক্লান্ত। হাতে কালো কাঠ পেন্সিল। মাঝে মধ্যে ঠোঁটে এসে ওঠে পেন্সিল। ইদানিং প্রায়ই সে ছুঁড়ে ফেলে তা। কী লিখবে সে বোধহয় ভুলে যায়। ঠিক তখনই মাথার উপর দিয়ে উড়ে যেতে যেতে কাকেশ্বর কুচকুচে ক্যাঁ ক্যাঁ করে হাঁক পাড়ে। সব ইতিহাস কে লিখতে পারে? যা দেখো তাই লেখো তো বাপু! পাশ দিয়ে যেতে যেতে টুক করে তার কথা কলমের ডগায় লুফে নেই আমি। সব. কথা ধরতে নেই তবু, কাকেশ্বরের এই কথাটি বড় মনে ধরে আমার। শিলিগুড়ির ইতিহাস ইতিমধ্যে লিখে ফেলেছেন অনেক শ্রদ্ধাভাজন। তুখোড় কলমবাজ রিপোর্টারের দৌলতে শিরোনামে থাকা শিলিগুড়ির কদর বেড়েই চলেছে। আমি বরং কিছু পরিবর্তনের চিহ্ন ধরে রাখি। সত্তর,আশি, নব্বই, শূন্য... এগিয়ে যাক কথাগাড়ি। আজ না হয় হাট বাজার দিয়েই কথা শুরু করা যাক...।
শিলিগুড়ি রেলস্টেশন বা টাউন স্টেশন সংলগ্ন অঞ্চলেই মূলত ছিল শিলিগুড়ি শহরের বাজার। আর তা ছিল স্বাভাবিক ভাবেই। এবং সেটা গড়ে ঊঠেছিল যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে। তবে, চাহিদা, যোগান এবং রুচি সব মিলিয়ে তখন বর্ধিষ্ণু আর ঐতিহ্যবাহী জলপাইগুড়ি শহরের বাজারের গুরুত্ব ও মান্যতা ছিল বেশি। গুরুত্বপূর্ণ ছিল মাটিগাড়া হাট। শিলিগুড়ি মহকুমা হিসেবে ১৯০৭এর ২৫শে মে স্বীকৃত হলেও বাজার ব্যবস্থা উল্লেখযোগ্য ছিল না। নির্ভরতা ছিল একদিকে জলপাইগুড়ি অন্য দিকে কাটিহার এই দুই অঞ্চলের প্রতি। তখন প্রধান বাজার বসতো এখনকার মহাবীর স্থান অঞ্চল ঘিরে। ব্যবসা ছিল মূলত অবাঙালিদের। স্টেশনারি, মণিহারি, কাপড়ের দোকান এবং মিষ্টির দোকান। আর ছিল ফল ও সবজি কেনাবেচার দোকান ও আলুপট্টি।
এই পরিস্থিতি বদলে গেল সত্তরের দশকে এসে। জলপাইগুড়ি শহর তখন উত্তরবঙ্গের মধ্যমণি বলা যায়। সেখানেই গড়ে ওঠার কথা ছিল বৃহত্তর একটি বাজার। কিন্তু হলো না। তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বিধান চন্দ্র রায়ের উদ্যোগে রোড স্টেশনের বিপরীত দিকে তৈরি হলো নতুন এক বাজার। এটিই আজকের বিধান মার্কেট। কলকাত্তাই কায়দা ও অনুকরণে এটিকেই তখন ডাকা হতো নিউ মার্কেট নামে। মহাবীরস্হান ও সংলগ্ন টাউন স্টেশন বাজারের তুলনায় এই বাজার নতুন বৈকি! তার চেয়েও বড় কথা এই সময় থেকেই শহর শিলিগুড়ির বাণিজ্যিক কেন্দ্র হিসেবে গড়ে উঠতে থাকা।
জনশ্রুতি, দূরদর্শী বিধান চন্দ্র রায় বাণিজ্যকেন্দ্র হিসেবে শিলিগুড়ির গুরুত্ব অনুধাবন করেছিলেন। বিধান মার্কেট ক্রমে শহরের অন্যতম বাজার বলে পরিগণিত হতে থাকে। বিভাজিত বাংলাদেশ ও আসাম থেকে আসা বাঙালি ব্যবসায়ীদের চেষ্টায় ও উদ্যোগে শহরের প্রধান বাজার বলে ক্রমে গণ্য হয়। রোড স্টেশন, যার বর্তমান নাম হাসমি চক তা পেরিয়ে এলেই কাঞ্চনজঙ্ঘা স্টেডিয়াম। এবং স্টেডিয়াম পেরিয়ে গমগমে জনবহুল অঞ্চল বিধান রোড। সংলগ্ন বাজারটি বিধান মার্কেট। সত্তরের মাঝামাঝি সময়ে খুচরো ব্যবসায়ীদের গড়ে তোলা আরেকটি বাজার হলো হংকং মার্কেট। একে বিধান মার্কেটের বর্ধিত অংশই বলা যায়।
তবে এখন নিজস্বতা নিয়ে অনেক আলাদা হংকং মার্কেট। গণ প্রজাতন্ত্রী চিনের অন্তর্গত েলাকা হংকং। সেই নামে বাজারের নামকরণে অভিনবত্ব থাকলেও অধিকাংশ সামগ্রী আসে শিলিগুড়ি থেকে ২৫ কিলোমিটার দূরের নেপাল সীমান্ত হয়ে ঘুরপথে। বিদেশি পণ্য এবং সস্তা দাম, পর্যটকদের আকর্ষণের এটাই মূল বিষয়। সস্তা দামে ক্রেতাকে চুম্বকের মতো টানে হংকং মার্কেট। কিছু অংশ বিধান মার্কেটের মধ্যে পড়লেও নিজস্ব হোর্ডিং আর সহজলভ্য দামের অনবদ্য শৈলীতে দাঁড়িয়ে আছে কয়েক দশক ধরে হংকং মার্কেট। শুরুতে দোকান ছিল গোটা পঞ্চাশেক আর এখন হাজার ছুঁই ছুঁই! এর ঠিক পাশেই আছে শেঠ শ্রীলাল মার্কেট। হংকং মার্কেট-এর তুরুপের তাস যেমন কম দাম, শেঠ শ্রীলাল মার্কেটের ইউএসপি তেমন ব্র্যাণ্ডেড, হাল ফ্যাশান। গ্ল্যামার আর বৈভবে উজ্জ্বল শেঠ শ্রীলাল মার্কেট।
এরই মাঝে আশির দশকের শেষ দিকে এবং নব্বইয়ের শুরুতে বাঙালির ফ্যাশানে দোলা দেয় বুটিক কালচার। শিলিগুড়ি শহরেও এই ঢেউ এসে পড়ে। শুরুতেই যে দুটি বুটিক শহরের ফ্যাশানের হাল ঘুরিয়ে দিয়েছিল.. তারা হলো সানন্দা এবং শিঞ্জিনী বুটিক। ১৯৮৭ থেকে বছর দশকের মধ্যে শিলিগুড়ির অলিগলিতে গড়ে ওঠে অনেকগুলি বুটিক। শৈল্পিক ও দৃষ্টিনন্দন স্বতন্ত্র পোশাক সম্ভারে ও সিগনেচারে আকর্ষণীয় হয়ে উঠতে থাকে বুটিকগুলি। সমঝদার ক্রেতার কাছে বুটিক জনপ্রিয় হয় সাধ্য আর পছন্দের বোঝাপড়ায়। শৈল্পিক মুন্সিয়ানায় অবাঙালি ক্রেতার কাছেও পৌঁছে যায় বুটিক। মূলত, রাজস্হানি, গুজরাটি ওডিশি কাজের পাশাপাশি শান্তিনিকেতনের কাঁথাস্টিচ প্রভৃতি গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠে। তবে, বুটিকচর্চার একটা মূল সমস্যা ছিল, জিনিসপত্র সবই আনা হতো বাইরে থেকে.. কোনো স্হানীয় কারখানা ছিল না বা হাতের কাজ জানা তেমন শিল্পীর যোগানও ছিল না।এর ফলে দাম অনেক সময় মধ্যবিত্তের আওতার বাইরে চলে যেতো।
এরপরই ঘটল অদ্ভুত সমাপতন। শূন্য দশকের শুরুতেই তৈরি হলো বিভিন্ন শপিং মল। সেখানে কিনলেও চলে, না কিনলেও হয়। মুফতে দিব্যি ঘোরাঘুরি হয়। পয়সা লাগেনা। আর কিনলে ব্র্র্যাণ্ডেড, জাতে ওঠা যায়। শহর মজে গেল! শিলিগুড়ি শহরের প্রথম শপিং মল কসমস তৈরি হয় এক দশক আগে। এই শহরে শপিং মলের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। সেটা ভালো না মন্দ সময় সে কথা বলবে, তবে পানিট্যাঙ্কি মোড় পার হলেই ঝাঁ চকচকে দোকান আর ছোট বড় এই শপিং মল তাক লাগিয়ে দেয় বৈকি!
আর আছে অনলাইন বিজনেস। অনলাইন মার্কেট অবশ্যই নতুন না। আশির দশকে জলপাইগুড়ি শহর থেকে চমৎকার তাঁতের শাড়ি নিয়ে বাড়ি বাড়ি আসতেন বসাকদা। সেসব শাড়ি বেশিরভাগ শান্তিপুর, ফুলিয়ার বোনা। কিংবা ধনেখালি তাঁত। আশির দশক জুড়ে ছিল পাড়াতুতো কাকিমা, দিদি, বৌদিদের বাড়িতে এনে শাড়ি দেখানো। এক বাড়ি এলে পাঁচ বাড়ির মানুষের ভিড়। বিধান মার্কেটের এক শাড়ির দোকানের মালিক জানালেন, একসময় সাইকেলে করে গাঁটরি নিয়ে পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে বেরিয়েছি। তারপর এই দোকান। কিছু বিক্রি টাকা ফেলে রাখা, ধার বাকিতে জিনিস দিয়ে সামান্য মুনাফা। উপরি লাভ দোকান ভাড়ার চাপ না নিয়ে কিছু সাশ্রয় সামান্য লাভের মুখ দেখা। সংসারী গেরস্তেরও মাসিক কিস্তি দিয়ে কিছুটা শান্তি। পারস্পরিক বোঝাপড়ায় দুপক্ষেরই লাভ। সমান্তরাল অসামান্য এক বাজার ব্যবস্থা। সন্দেহ নেই এই বাজারের ক্রেতা ছিলেন মূলত মহিলারা। এবং মধ্যবিত্ত, নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারগুলি। এখন বিশ্বায়নে ফলে বাজার হাতের মুঠোয়। স্পেন্সার, জিও মার্ট সব বিশ্বজনীন কোম্পানিগুলো হাতের মধ্যে ঘরে বসেই পৌঁছে দিয়ে যায় নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র। আর তেমনি পোশাকআশাক, শাড়ি গয়নার সম্ভার রয়েছে হাতের মধ্যেই। দোকানের দরকার কোথায়?
সামলে সুমলে দিব্যি চলছিল বাজার ব্যবস্থা। কিন্তু ঘেঁটে দিল শপিং মলগুলি আর তার পরে সর্বনাশা করোনা ব্যাধি। বিধান মার্কেটের রমরমা সেই দিন আর নেই। অগুনতি দোকানগুলি আছে খরিদ্দার নেই। আক্ষেপ করেন পোশাকের দোকানের দোকানদার, "খুব দুশ্চিন্তায় দিন কাটে..কতটা মাল তুলবো..কতটা লাভ রাখবো.. বুঝে উঠতে পারিনা"। শেঠ শ্রীলাল মার্কেটের সেই গ্ল্যামার দূর অস্ত। জেগে আছে শুধু টগবগে হংকং মার্কেট। আর আছে, চার্চ রোডের সংলগ্ন এলাকার সানডে হাট। আছে কাওয়াখলির শিল্পী হাট। এসবের মধ্যেই জেগে আছে প্রাণবন্ত শিলিগুড়ি।
বাণিজ্যশহর শিলিগুড়ির বাণিজ্যরথ কীভাবে এগোবে? শিলিগুড়ির বাজার কী পুনরুজ্জীবিত হয়ে উঠবে নতুন নতুন? পথে নাকি সমতল নয়, পাহাড় আর পাহাড়ি মানুষের প্রযোজনই তাকে বাঁচিয়ে রাখবে সঞ্জীবনী মন্ত্রে? মহাকালের রথ তো এগিয়ে যাবেই ! তবে, "শেষ নাহি যে শেষ কথা কে বলবে!"
(চলবে)
Have an account?
Login with your personal info to keep reading premium contents
You don't have an account?
Enter your personal details and start your reading journey with us
Design & Developed by: WikiIND
Maintained by: Ekhon Dooars Team